আহমদ ছফার ‘তিনশ টাকার চেক’

সিদ্দিকুর রহমান খান |

মনীষী লেখক, দার্শনিক, ও কবি আহমদ ছফাকে নিয়ে লেখার জন্য করোনাকালে কবিগুরুর বয়ানে ‘যাসনে ঘরের বাহিরে’ বিধান উপেক্ষা করে বাংলা একাডেমির ভেতরে থাকা অগ্রণী ব্যাংকের ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। গত ২৫ জুন তোলা ছবিগুলোর একটি আমার ফেসবুকে প্রকাশ করেছি। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ঢাকা শহরে অগ্রণী ব্যাংকের কয়েকডজন শাখা থাকতে বাংলা একাডেমির শাখাটির ছবি কেন? এই কৈফিয়ত দেয়ার আগে দুটো কথা বলে নিতে চাই।  

১৯৯৬-৯৭ খ্রিষ্টাব্দের কথা। সরকারি জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র হলেও দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় সরকারি অফিসে অফিসে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে ও রিপোর্ট লিখতে। একটা রিপোর্ট প্রকাশ হলে তখন যে আনন্দ হতো এখন ৫০ হাজার টাকা পেলেও তার সমান আনন্দ পাই না। একটি লেখা প্রকাশ হলে সহপাঠীদের অনেকে ঈর্ষার চোখে দেখতো। তখন তা খুব মজার বিষয় ছিল। তবে, এই লেখালেখিতে কত টাকা পেতাম তা সাংবাদিকদের বেতন-কড়ির খবর যারা রাখেন তাদেরকে আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। টাকা বড় বিষয় নয়, ছাপার অক্ষরে লেখা প্রকাশ হয়েছে সেটাই ছিল পরিতৃপ্তির বিষয়।  

সেইসব দিনগুলোতে ঢাকার বাংলামোটরে আহমদ ছফার বাসা অথবা শাহবাগের আজিজ মার্কেটের আড্ডাখানায় প্রায় প্রতিদিনই যেতাম। আড্ডা ছাড়াও আমার কাজ ছিল ছফা ভাইয়ের লেখার ডিকটেশন নেয়া। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন ছফা ভাই। বিশেষ করে সাহিত্যপাতায় তার লেখা বেশি ছাপা হতো। তখন ডিজিটাল পদ্ধতি ছিল না। মোবাইলও ফোনও খুব কম ছিল। ছফা ভাইয়ের একটা ৯৬৬.. টিএন্ডটি নম্বর থাকলেও আমার কোন ফোনই ছিল না। অগত্যা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে মাঝে-মধ্যে ফোন দিয়ে জেনে নিতাম কখন কোন লেখার জন্য বাসায় অথবা আজিজে যেতে হবে। এই যে টাকা নেই তারপরও টাকা খরচ করে ফোন করতাম কেন? আমার লাভের জন্যই। দুইভাবে লাভ। যেসব লেখার ডিকটেশন নিতাম সেগুলোতে  লেখক ছফা ভাইয়ের নাম থাকতো। আর নিচে লেখা থাকতো, অনুলিখন: সিদ্দিকুর রহমান খান।

ছফা ভাইয়ের লেখার সাথে আমার নাম যাচ্ছে তা সে সময় আমার কাছে এটার যে কি মূল্য তা এখন পুরোটা বোঝাতে পারবো না। রীতিমতো গর্ব করতাম। এখানেও সহপাঠী ও সহকর্মী সাংবাদিকদের ঈর্ষাপরায়ণতাটাকে উপভোগ করতাম। ওই সময়ে ছফার মতো মনীষীর নামের সাথে আমার নাম ইত্তেফাক, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হওয়াকে বিশাল পাওয়া মনে করতাম। দৈনিক পত্রিকার হার্ড রিপোর্টার হিসেবে নিজের লেখা হাজার হাজার রিপোর্ট প্রকাশ হলেও ছফা ভাইয়ের নামের সাথে আমার নাম প্রকাশ হওয়াটাকেই আমার কাছে ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন মর্যাদার মনে হতো, এখনও হয়। এখনও মনে করি বিশাল সৌভাগ্য আমার, ছফার এ্যাতো এ্যাতো স্নেহ পেয়েছি। এখনও কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘সিদ্দিক, আপনার সাথে তো আহমদ ছফার জানাশোনা ছিল, তাই না। তখন ঘুরিয়ে আমি বলি, শুধু পরিচয় ছিল না। আহমাদ ছফার অনেকগুলো প্রবন্ধ/নিবন্ধ ও বইয়ের মধ্যে যে সাংবাদিক সিদ্দিকুর রহমান খানের উল্লেখ দেখেন সেই সিদ্দিকুর রহমানই আমি’। 

প্রিয় পাঠক, এবার আসি অগ্রণী ব্যাংকের ছবি তোলা প্রসঙ্গে। ২৫ জুন ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। দেখলাম আগের সেই জীর্ণ ভবনটি নেই। কাঁচঘেরা অত্যাধুনিক এক ভবন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তুলতে মনে পড়ছিল সেই ম্যানেজার সাহেবের কথা। তাঁর নামটি অনেকবছর মনে রেখেছিলাম, এখন মনে পড়ছে না। এই ম্যানেজার সাহেব অন্য দশজন ম্যানেজারের চেয়ে আলাদা। আহমদ ছফার সাথে সখ্য না থাকলেও ছফার লেখালেখি এবং আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানা ছিল তাঁর।

খুব সম্ভবত ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের শেষদিকে। দুদিন ধরে ছফা ভাই আমাকে বলছেন, সিদ্দিক তোমাকে কিছু টাকা দেবো। আমার খুব খুশি হওয়ার কথা থাকলেও জানতাম ছফা ভাইয়ের টাকা নেই। তাই নিম্ন স্বরে বলতাম, না ভাই, দরকার নেই। আমি অফিস থেকে কদিন আগেই কিছু টাকা পেয়েছি। যদিও সংবাদপত্র অফিস থেকে টাকা পাওয়ার কথাগুলো কতটা সত্য বা সত্যের কাছাকাছি তা আমি ছাড়া আর কে জানতো!

যাহোক, এক সকালে ছফা ভাইয়ের বাসায় গেলাম। এক নাগাড়ে তিনটা বড় লেখা লিখতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। তখন কর্ণফুলি পেপার কোম্পানির লম্বা সাইজের সাদা কাগজে লিখতেন ছফা ভাই। এক পাতায় লিখতে হতো। এপিঠ-ওপিঠ লিখতে মানা। লেখা শেষে আমার হাতে একট চেক দিলেন। চেকের দিকে তাকালাম না। ভাজ করে পকেটেও ঢুকালাম না। শুধু বললাম ছফা ভাই লাগবে না। বললেন, তাড়াতাড়ি যাও ব্যাংক আওয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলামোটর থেকে মনে হয় বাংলা একাডেমির অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় যেতে আমার পনেরো মিনিটের বেশি লাগেনি। অগ্রণী ব্যাংকে ঢুকে চেকটা দিতে চাইলাম একজনের কাছে, তিনি ইশারা করে বললেন, এখানে না ওখানে। গেলাম সেই ডেস্কে। চেকটা রেখে একটা পিতলের টোকেন ধরিয়ে দিল মনে হয়। পুরোটা মনে পড়ছে না। কিছুক্ষণ পড়ে একজন অফিস সহকারী টাইপের ভদ্রলোক লোক এসে বললেন, সিদ্দিকুর রহমান খান কে? আমি এগিয়ে গেলাম। বললেন, আসেন আমার সাথে। তিনি নিয়ে গেলেন ম্যানেজার সাহেবের রুমে। ম্যানেজারের হাতে থাকা চেকটার দিকে সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম লাল কালি দিয়ে কি যেন লিখেছেন ব্যাংকেরই কেউ। আমাকে আর টাকা দেবে না এমনটা সন্দেহ হলো। মন খারাপ হলেও বুঝতে না দেয়ার চেষ্টা করে যেতে থাকলাম। চশমার ফাঁক দিয়ে ম্যানেজার সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ছফা সাহেব আপনার কি হন? আমি কি করি? কখন এই চেক লিখে দিয়েছেন ছফা সাহেব? এ্যাতো এ্যাতো প্রশ্ন শুনে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবুও জবাব দিলাম। সব  শেষে জিজ্ঞেস করলেন, এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো? আমার উত্তর শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হয়েছেন মনে হলো। লাল কালি দিয়ে আকাঁবুকি করা চেকটার ওপর ফের কি যেন লিখলেন ম্যানেজার সাহেব। ক্যাশিয়ার বা ক্যাশ শাখার কেউ একজনের সাথে ম্যানেজারের আলাপে বুঝলাম ছফা ভাইয়ের ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিনশ টাকা ছিল না। দুশো অথবা দুশো পঞ্চাশ টাকার মতো ছিল। তবু, মনীষী ছফার চেকটি ডিজঅনার করেননি। তিনশ টাকাই দিয়েছিলেন আমাকে। 

ম্যানেজার সাহেব আমাকে বললেন, ছফা সাহেবকে বলবেন, খুব তাড়াতাড়ি যেন কিছু টাকা এই শাখায় জমা রাখেন। ম্যানেজারের মুখের দিক তাকিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বের হলাম। ক্যাশ শাখা থেকে একজন ডেকে নিয়ে আমাকে তিনশ টাকা দিলেন। আমি ব্যাংকের ভেতরে থেকেই গোপন পকেটে টাকাগুলো ঢুকিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করলাম ছফা ভাইয়ের বাসার দিকে। এবার পকেটে টাকা আছে। এবার মনে হয় দশ মিনিটে  পৌঁছে গেলাম বাংলামোটরে। টাকাগুলো হাতে দিতে চাইলে ছফা বললেন, ‘আরে বোকা এটাতো তোমাকে দিয়েছি। যাও অফিসে যাও। কাল বিকেলে আজিজে এসো। মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে আজকের কাগজের জন্য একটা লেখা দিতে হবে। সাহিত্য সম্পাদক সালাম সালাহউদ্দিন সাহেব ফোন দিয়েছিল।’

আমার কাছে মনে হলো ম্যানেজার সাহেব যা বলেছেন এবং আমিও ম্যানেজারের প্রশ্নবানে যে ভড়কে গিয়েছিলাম তা ছফা ভাইকে বলা দরকার। সবশেষে বললাম, ম্যানেজার বলেছেন খুব শিগগিরই যেন কিছু টাকা জমা রাখেন। শুনে হেসে দিলেন ছফা। বললেন, বুঝতে পেরেছো, তিনশ টাকা ছিল না আমার এ্যাকাউন্টে। তবুও তোমাকে টাকা দিলেন। ম্যানেজারের নামটা আবার বলো সিদ্দিক।’  

পাদটীকা : দুই যুগেরও বেশি সময় আগের ছফাভক্ত সেই অসাধারণ ম্যানেজারের নামটা ভুলে যাওয়া বা তার খোঁজ না রাখা আজও আমার কাছে অপরাধ মনে হয়। আর মাত্র কয়েকবছর আগে সরকারি বেসিক ব্যাংক যে ‘সরল বিশ্বাসে, কোনো কাগজ বা গ্যারান্টার ছাড়াই এক ব্যক্তিকে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দিলেন।’ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনগুলো এবং ঋণ গ্রহীতার নাম এবং বেসিক ব্যাংকের সেই শাখার ম্যানেজারের নাম মনে রাখাও অপরাধ!

আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে এইসব অপরাধের রকমফের নিয়ে দারুণ লিখতেন। তাঁকে মিস করি, তাঁর লেখা মিস করি। আজ ৩০ জুন তাঁর শুভ জন্মদিন।

লেখক: সিদ্দিকুর রহমান খান, সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম।  


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028049945831299