‘ইউজিসি সমাচারের দর্পণ’ শিরোনামের নিবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বেগম জাহান আরা লিখেছেন, .. এর চেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হল সব দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্ব যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ওপর অর্পিত, সেই ইউজিসির বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তারই কোনো উচ্চশিক্ষা নেই। কেউ কেউ কলেজ কিংবা বিশ্বদ্যিালয়ের চৌকাঠ মাড়ায়নি, এমন ব্যক্তিও ইউজিসির কর্মকর্তা। টেনেটুনে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেছে, এমন গুণের কর্মকর্তা এখন প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আছে। সত্যি ভয়াবহ অবস্থা! ঘুষ নেয়া তো প্রমাণিত হয়েছে এবং এক কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়েছে।
অধ্যাপক জাহান আরার লেখায় আরো যে তথ্য পাই তা হলো, ...মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, তাদের অনেকেরই স্নাতক ডিগ্রি পর্যন্ত নেই। ডাকসাইটে আমলা ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের বরাতে তিনি লেখেন, ‘উচ্চশিক্ষার মান রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, সেখানেই যদি গলদ থাকে, তাহলে সেটা জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য।’
অধ্যাপক জাহান আরার আরো লেখেন, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক ফেরদৌস জামানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন।কুমিল্লায় অবস্থিত ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে জানিয়েছে, ফেরদাউস জামানকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দেয়া হয়েছে।… যেভাবে ইউজিসি কর্মকর্তারা ঘুষ কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছেন, এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অশনি সংকেত।
জাহান আরার লেখাটি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত।
সেই একই লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের মন্তব্য, ‘আমি খুবই মর্মাহত। উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে যে সংস্থাটি আছে, সেটাই যদি কলুষিত হয়, তাহলে আর রক্ষা নেই।মঞ্জুরুল ইসলামের ভাষ্যে, অবিলম্বে উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে কলুষমুক্ত করতে হবে। অন্যথায় এ সমস্যা আরও গভীর হবে।’
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২রা আগস্টে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউজিসির প্রথম শ্রেণির পদে চাকরিরত গুরুত্বপূর্ণ ৫ কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস। তাদের কেউ কেউ আবার তৃতীয় বিভাগে পাস। প্রশাসন শাখার সচিব মোঃ শফিউল্লাহ তেমনি একজন। তিনি তৃতীয় বিভাগে এসএসসি পাস। (তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন)। বর্তমানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। ইউজিসির চেয়ারম্যান দফতরে কর্মরত সহকারী সচিব (লিয়াজোঁ অ্যান্ড প্রটোকল) মোঃ আবদুল ওয়ারেছ দাখিল পাস। তিনি পিয়ন পদে চাকরিতে যোগ দিয়ে চেয়ারম্যানের প্রটোকল সহকারী সচিব। [বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেছ এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক।] প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব সৈয়দ এহতেশাম আলী, মোহাম্মদ শরীয়তুল্লাহ, রিসার্চ এবং পাবলিকেশন বিভাগের ডকুমেন্টেশন অফিসার মোঃ সহিদ উল্লাহ।
এছাড়াও ৭ জন কর্মকর্তা টেনেটুনে এইচএসসি পাস করেছেন। তারা হলেন- প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব আনোয়ার হোসেন ও এনামুল হক, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলাম, অর্থ ও হিসাব বিভাগের সহকারী পরিচালক মুন্সী দাউদ হোসেন এবং প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব শাজাহান মিয়া। ইউজিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও অনেকে তৃতীয় বিভাগে পাস করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মোঃ শামসুল আলমও এইচএসসিতে তৃতীয় বিভাগে পাস করেছেন। যায়যায়দিনের প্রতিবেদনে আরও কিছু কর্মকর্তার নাম আছে, যাদের ডিগ্রিগত যোগ্যতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিই সম্পদ। অর্থাৎ এত বড় বড় দায়িত্বে যারা কাজ করছেন, তাদের শিক্ষা জীবনে মেধাগত এক্সেলেন্স তো নেই-ই, উচ্চতর ডিগ্রিও নেই। এমন প্রতিষ্ঠান কেমন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাদানের গুণগত মান বিচার করবে সে প্রশ্ন তো উঠবেই। কেমন করেই বা নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শর্ত, পাঠ্য বিষয়ের গুরুত্ব এবং বিষয়গত শিক্ষকদের গুণগত মান নিয়ে তারা মত দেবেন বা সিদ্ধান্ত নেবেন? কেমন করেই বা শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রি এবং গবেষণার বিষয়ে প্রেরণা দেবেন?
এবার আরেকটি প্রসঙ্গ। ইউজিসির সাবেক সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (গত বছর প্রয়াত) ড. তারেক শামসুর রেহমান ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন দৈনিক যুগান্তরে লিখেছেন, … একজন ইউজিসি মেম্বর কেন তার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছেলেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন? নিজে কেন সেই বোর্ডে সভাপতিত্ব করবেন, যে বোর্ড তার মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য মনোনীত করবে? এ ধরনের অনিয়মের দু-একটিই সংবাদপত্রে ছাপা হয়। অনেকই ছাপা হয় না। কিন্তু যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তারা অনেকেই জানেন অনিয়মগুলো কোথায় কোথায় হচ্ছে।’
নিয়োগ কেলেংকারিতে জড়িত হয়ে ইউজিসির একজন সচিব বরখাস্ত হয়েছেন কয়েকবছর আগে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি ইউজিসিতে নিয়োগ চলছে। সেখানে আবাসন ব্যবসায়ী, ঘুষ কেলেংকারিতে যুক্ত, স্টক মার্কেটের অভিজ্ঞদের পরিকল্পনায় যেন নিয়োগ বোর্ড সাজানো না হয়। এক বাক্য নির্ভুল বাংলা ও ইরেজি লেখা ও বলার মতো যোগ্য, সৎ ও দক্ষ জনবল যেন নিয়োগ হয় উচ্চশিক্ষার দেখভাল করার এই প্রতিষ্ঠানটিতে। এই আশা।
হাবিবুর রহমান , ঢাকা