রাজধানী গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসাসেবায় অবহেলা এবং রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। দেশের অন্যতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হকের স্বজনদের অভিযোগ, তিনি চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তার অবহেলা ও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় সুচিকিৎসা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের কর্মকর্তা মো. শরীফ গত বুধবার রাতে গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। যার নম্বর ৭৯।
এদিকে, অভিজাত এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার নামে একের পর এক ঘটছে অমানবিক কর্মকাণ্ড। গুরুতর বা স্পর্শকাতর রোগীদের জীবন-মরণ নিয়ে চলছে রীতিমতো বাণিজ্য। এ ছাড়া রোগীর শারীরিক অবস্থার সুযোগ বুঝে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের ফন্দি এঁটেও স্বজনদের সঙ্গে চলছে ছিনিমিনি খেলা। এমনই অমানবিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হকের সঙ্গেও।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, কেবল এই বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সঙ্গেই নয়, এর বাইরেও ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে গালফ এয়ারলাইন্সের একজন বিদেশি পাইলট মোহাম্মদ ইউসুফ হাসান আল হেন্দিকে গুলশানের ওই ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে তার যথাসময়ে এবং ঠিকমতো চিকিৎসা না করায় করুণভাবে ওই পাইলটের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ আনেন তার বোন তালা ইলহেন্দি জোসেফানো।
মৃতের বোন তালা ইলহেন্দি এ ঘটনাকে চিকিৎসায় অবহেলার মাধ্যমে হত্যা বলেও অভিযোগ করেন। এর আগে ২০২০ সালের জুনে পাঁচজন রোগীর অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্তা-ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয় গুলশান থানায়। ওই সময় এ হাসপাতালের চেয়ারম্যান-এমডিসহ কয়েকজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল।
দেশের অন্যতম শীর্ষ এ ব্যবসায়ী এম এম এনামুল হকের স্বজনরা জানিয়েছেন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে গত ২৭শে জানুয়ারি এ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের ৬০৩ নম্বর ভিভিআইপি কেবিনে চিকিৎসা চলে আসলেও গত বুধবার (১লা জানুয়ারি) সারা দিন বিনা চিকিৎসায় কেবিনে ফেলে রাখা হয় তাকে। এমনকি তার শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক উচ্চমাত্রার ইনজেকশন দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি।
তার কিছু পরে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হওয়ায় টাকা আদায়ের ফন্দি নিয়ে হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার রওজার এলিস্টার এজেক এসে রোগীকে বলেন, আমাকে দুই লাখ টাকা দিলে ইনজেকশনসহ ডাক্তারের ব্যবস্থা করে দেবো। এসময় ডিউটি ম্যানেজারের সঙ্গে হাসপাতালের অজ্ঞাতনামা আরও দুই-তিনজন এসে যুক্ত হয়ে একই স্বরে সুযোগ সন্ধানী আচরণ করতে থাকে। এমন অবস্থায় রোগী ও তার স্বজনরা চিকিৎসাসেবার প্রকৃত খরচের বাইরে ওই অতিরিক্ত টাকা দিতে অসম্মতি জানান। তখন হাসপাতালের এই কর্মকর্তা বা কর্মীরা রোগীর শারীরিক অবস্থা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নানা ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে রোগী ও স্বজনরা তাদের অন্যায় ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সেখানে হাসপাতালের লোকজন জড়ো হয়ে হৈচৈ শুরু করে। পরবর্তীতে খবর পেয়ে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আসেন সেখানে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাসপাতালের ওইসব অমানবিক কর্মীদের পক্ষ নিয়েই কথা বলতে থাকেন। এর ফলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এম এম এনামুল হক সেখানে ভর্তি থাকলেও তার সুচিকিৎসা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। তবে উপস্থিত হাসপাতালের পরিচালক এসে বলেছেন, এ ঘটনায় যারা অবহেলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কর্নেল (অব.) বশির গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি থেকে এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। তারপরও এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে হাসপাতালের কেউ অপরাধ করে থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে গুলশান থানায় দায়েরকৃত সেই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হাফিজুর রহমান জায়েদ সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার রাতেই ওই বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছি। প্রাথমিকভাবে ঘটনা জেনে মনে হয়েছে, হাসপাতালে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও ব্যবস্থাপনাগত কিছু ত্রুটি ছিল। একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট মূলত, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যানের চিকিৎসায় নির্ধারিত ছিলেন। ওই চিকিৎসক নাকি পারিবারিক কাজে হাসপাতালে আসতে পারেননি।
তবে অন্য চিকিৎসককে তিনি নাকি দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে এ ধরনের একজন রোগীর আস্থা সংকট হওয়ায় স্বাভাবিক। হাফিজুর রহমান আরও বলেন, জিডি হওয়ার পর এটি আদালতে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। আদালতের অনুমোদন হলেই ইউনাইটেড হাসপাতালের অভিযুক্তদের বিষয়ে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।