নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানান, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার নির্যাতন ও হুমকির শিকার দুই ছাত্রীকে রাতেই হল থেকে স্থানীয় অভিভাবকের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। হল প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা ও কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য তাদেরকে হলের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
রাজধানীর ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার নির্যাতন ও হুমকির শিকার সেই দুই ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। কলেজের রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীদের এক সহপাঠী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতেই তাদের হল থেকে স্থানীয় অভিভাবকের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময় হল প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা ম্যাম আর কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া (সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য) ম্যাম তাদের হল গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
এদিকে কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য ও হল প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার মোবাইল ফোনে ১৫ বার কল দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বুধবার দুপুরে ভিন্ন একটি নম্বর থেকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেন। তবে এই প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়ার পর ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন। পরে তার মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
একই বিষয়ে জানতে অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যকেও মঙ্গলবার রাত থেকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ১০ বার ফোন দেয়া হয়েছে। কিন্তু রিসিভ না করায় তার বক্তব্যও জানা সম্ভব হয়নি। পরে তার মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনিও উত্তর দেননি।
তবে ওই দুই শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের হয়ে যেতে নারগিস রুমার নির্দেশ দেয়ার একটি ভিডিও হাতে এসেছে। ভিডিওটি মঙ্গলবার রাতের।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ছাত্রলীগ নেত্রী রিভার নির্যাতন ও হুমকির শিকার দুই শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমার দাঁড়িয়ে আছেন। নারগিস রুমা তার চেয়ারে বসে আছেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তাকে বলতে শোনা যায়- ‘তোমরা এখনই বাড়ি চলে যাও। আমি বলছি, তোমরা এখনই বাড়ি চলে যাবে।’
এরপর বিভিন্ন কথার পর প্রাধ্যক্ষকে আবার বলতে শোনা যায়, ‘শোনো মিথিলা (ভুক্তভোগীদের একজন), তুমি চলে যেতে চাচ্ছ না। এখন তোমরা দুইটা গ্রুপের মধ্যে হয়ে গেছ। কোন একটা গ্রুপের জন্য তোমাদের ক্ষতি হতে পারে। এই দায়টা কে নেবে?’
এরপর ভুক্তভোগী মিথিলা বলেন, ‘তাহলে ম্যাম এখন আমাদের কী করা উচিত?’ তখন প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘তোমরা এখনই বাড়ি চলে যাও। আমি তোমাদের পাঠিয়ে দিয়ে তারপর এখান থেকে যাব।’
এ সময় পাশ থেকে আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘রাতে রাখা যায় কি না!’ তখন কলেজ ছাত্রলীগের এক নেত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘ম্যাম, রাতে রাখার দরকার নেই।’ আরেকজন বলেন, ‘ম্যাম, রাতে রাখা যাবে না।’
এরপর নারগিস রুমা বলেন, ‘না, রাতে রাখা যাবে না। তুমি বোঝো! রাতে কোনো ঘটনা ঘটলে এই দায় কে নেবে?’
সম্প্রতি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও ফাঁস হয়। এ ঘটনায় বেকায়দায় পড়েছেন রিভা। বিতর্কিত ওই অডিওর জন্য তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। ওই অডিওকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার হলের নিজ কক্ষে এই দুই ছাত্রীকে ৭ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন এবং নগ্ন করে ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করার হুমকির অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের এই নেত্রীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী ছাত্রীরাই এই অভিযোগ করেন।
দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় ওই দুই ছাত্রীকে নিজের হেফাজতে নিয়ে আসেন রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা। এ সময় সেখানে কলেজ ছাত্রলীড়ের কয়েকজন নেত্রীও উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
উপরের ভিডিওর কথোপকথনটি সেই সময়ের।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রী ভুক্তভোগীদের একজনের কাছে জানতে চান, রিভা (ছাত্রলীগ সভাপতি) তাদের সঙ্গে কী কী করেছেন আর কী জিজ্ঞাসা করেছেন। তখন এক ভুক্তভোগী তাদেরকে বলেন, ‘আপু, এই ভিডিওগুলো বাইরে গেলে আবার আমাদের ঝামেলা হবে। আমার এখন থেকে আরও কয়েকটা বছর এই হলে থাকতে হবে।’ এই কথা বলেই সেই ভুক্তভোগী কেঁদে ফেলেন।
পরে সেই নেত্রীরা তাদের কিছু হতে দেবেন না বলে আশ্বস্ত করেন।
এদিকে ভুক্তভোগীদের হল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই ভুক্তভোগীরা যে অভিযোগ করেছেন সেটির তদন্ত না করে উল্টো অভিযোগকারীদের হল থেকে বের করে দেয়া হল। এর মাধ্যমে কলেজ প্রশাসন নতজানু আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এখন থেকে আর কোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ করার সাহস করবে না। হল প্রশাসনই সেই পথ বন্ধ করে দিল। প্রশাসনের প্রতি ঘৃণা এবং লজ্জা।’
রিভাও ফোন ধরছেন না
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভাকেও মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭ বার ফোন দেয়া হয়েছে। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় রিভা দাবি করেন, ‘সব চক্রান্ত। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। বিএনপি-জামায়াত চক্র তাদের ছাত্রী সংগঠন দিয়ে এসব করাচ্ছে।
‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ সব মিথ্যা প্রমাণ হবে। চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন হবে।’