২০০১ থেকে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ। বাংলাদেশের জন্য এক অন্ধকার সময়। খ্রিষ্টাব্দ ২০০১, ১ অক্টোবর নির্বাচনে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। সময়টা ছিলো জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের। সেই এক ভয়াবহ বিভীষিকার ইতিবৃত্ত। তখন সারা দেশের মতো সন্ত্রাসের এক অভয়ারণ্যের নাম বরিশাল। সন্ত্রাসীরা স্থানীয় জামায়াত-বিএনপি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ছায়ায় তারা বিভিন্ন অপরাধ-খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, বাড়ি দখল, লুটপাট, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা অবাধে চালিয়েছে এই জনপদে। মানুষ ছিলো সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। ইতিহাসের পাঠ থেকে দু-একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই রাতে, উজিরপুর সদরের নিজ বাড়িতে উপজেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বাবুলাল শীলকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই উজিরপুরের কুড়ালিয়া বাজারে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় জল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অবনী বাড়ৈকে। এর দুইদিন আগে খুন হন ওয়ার্কার্স পার্টির স্থানীয় নেতা হীরালাল হালদার। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ, দিনে-দুপুরে বরিশাল শহরের সিঅ্যান্ডবি সড়কে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে ইউনুস খানকে। হত্যাকারীরা রাজনৈতিকভাবেই প্রতিপালিত হতো স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রশ্রয়ে। বিশেষ করে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনের পর এক ধরণের মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালানো হয় এই অঞ্চলের মানুষের ওপর। তখন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এই দুঃসময়ে মাটি ও মানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা মানুষের পাশে দাঁড়ান মানবতার ছায়ায়। সেবার ৫ দিনের সফরে যান দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল, ইতিহাসের নিন্দিত সেই দিনগুলোর একটি। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যখ্যাত বরিশালের উত্তর জনপদ গৌরনদী উপজেলার ঘটনা এটি। এদিন গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরেও গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে ওই হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, লুটতরাজের ঘটনায় প্রকৃত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা না করে উল্টো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। পরে ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। এটি শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার আরও একটি অধ্যায়। হত্যাচেষ্টাটি সংঘটিত হয় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রায় ৪ মাস আগে। ঘটনার পর দিন (৩ এপ্রিল) দেশের সকল গণমাধ্যম সংবাদটি ফলাও করে প্রকাশ করে।
দৈনিক জনকণ্ঠের শিরোনাম ছিল, ‘গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে সরকারী দলের ক্যাডারদের হামলা’। রিপোর্টটির খণ্ডিত বিবরণ- ... ‘বেলা ১২টা ২৫ মিনিটের সময় বিরোধী দলীয় নেত্রীর গাড়িবহর বরিশালের গৌরনদীর বাসস্ট্যান্ডের সামনে এসে পৌঁছে। রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতাকে পুলিশ লাঠিপেটা করছে দেখে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তার গাড়ি থামান। এ সময় স্থানীয় যুবদল সভাপতির নেতৃত্বে একটি দল আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবরোধ করে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘জহিরউদ্দিন স্বপনের এলাকায় অন্য কোন রাজনীতি নেই’। ...এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপনের ক্যাডাররা সম্মিলিত হামলা চালায়। তারা শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়ে। এতে ওবায়দুল কাদের, বাহাউদ্দিন নাছিম, ড. আওলাদ এবং ব্যক্তিগত ক্যামেরাম্যানসহ ৫/৭জন আহত হন। হামলার মূল টার্গেট ছিলো শেখ হাসিনা।’
৩ এপ্রিল ২০০৪, অন্য একটি দৈনিকে ঘটনাটির বিস্তারিত উঠে আসে এভাবে। যার শিরোনাম ছিলো, ‘গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে দফায় দফায় তেড়ে এসে হুমকি-ধামকি, গালিগালাজ’। রিপোর্টের বিবরণে বলা হয়, ‘বরিশালের গৌরনদীতে গতকাল শুক্রবার দুপুরে এক দল উচ্ছৃঙ্খল যুবক শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা করেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাঁচ দিনের সফরে ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছলে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা শেখ হাসিনার দিকে কয়েক দফা তেড়ে যায় ও তার গাড়িবহরের ওপর ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে। এ ঘটনার পর বরিশাল সার্কিট হাউসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হামলাকারীদের স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মী এবং বিএনপির স্থানীয় সাংসদের ক্যাডার বলে অভিযোগ করেন।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গৌরনদীতে শেখ হাসিনার কোনো নির্ধারিত পথসভা না থাকলেও স্থানীয় পৌরসভা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম সরোয়ার ফারুকের নেতৃত্বে দলীয় কিছু নেতা-কর্মী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। এক পর্যায়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের এক দল ক্যাডার সেখানে এসে তাদের নানা রকম হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তারা নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে ফুলের তোড়া ছিনিয়ে নেয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ ও বিএনপি ক্যাডাররা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের তাড়া করে।
বেলা সোয়া ১২টার দিকে শেখ হাসিনার গাড়িবহর গৌরনদী পৌঁছুলে সফরকারীরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন। গাড়িবহর থেকে নেমে যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাংসদ মির্জা আজম, ডা. আওলাদ হোসেনসহ বাহাউদ্দিন নাছিম, নিরাপত্তারক্ষীরা ব্যক্তিগত শেখ হাসিনার কর্তব্যরত এসআই আহসান হাবিবের কাছে দলীয় কর্মীদের বাধা দেয়ার কারণ জানতে চান। এ সময় কাছের একটি দোকানের পেছন থেকে ১০-১২ জন যুবক তাদের দিকে তেড়ে আসে। এরা গাড়িবহরের দিকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে। শেখ হাসিনা হ্যান্ডমাইক নিয়ে গাড়ি থেকে বের হলে যুবকরা তার দিকেও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। শেখ হাসিনা তার গাড়িতে দাঁড়িয়েই হ্যান্ডমাইকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যের সময়ও হামলাকারী যুবকরা তার দিকে তেড়ে আসে এবং চিৎকার করে তাকে স্থান ত্যাগ করতে বলে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমন বাড়াবাড়ি সহ্য করা হবে না, একদিন সময় আসবে। তখন এর উপযুক্ত জবাব দেবো।’
বরিশাল সার্কিট হাউসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগ যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় গৌরনদী এলাকার সরকারদলীয় সাংসদ জহিরউদ্দিন স্বপনকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, স্বপনের ক্যাডাররা আমাদের নেত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং আক্রমণ করতে তেড়ে আসে। এ হামলায় এসআই আহসানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি অংশ সহায়তা করেছে। এর আগে শেখ হাসিনা বরিশালের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পরপরই বিএনপি ক্যাডাররা সেখানে উপস্থিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের খোঁজাখুঁজি করে। এ সময় আগৈলঝাড়ার আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াছ তালুকদার ঘটনাস্থলে এলে বিএনপি ক্যাডাররা তাকে মারধর করে।
৪ এপ্রিল, ২০০৪, এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিলো, ‘বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে বা তাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে সরকারি দল কী ফায়দা পেলো তা বোঝা আমাদের সাধ্যের বাইরে।’ সম্পাদকীয়তে আরো উল্লেখ করা হয়, সরকার বা সরকারি দলের লোকজন যদি এ ধরনের কাজ করবেনই তখন ঘোষণা দিয়ে দিলেই তো হয় যে, গাড়িবহর নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী কোথাও যেতে পারবেন না।’ তবে বিস্ময়কর ও দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে- গৌরনদীর সাংসদ বিএনপির নেতা জহিরউদ্দিন স্বপন মিডিয়াকে বলেছেন, ‘গৌরনদীতে বিরোধীদলীয় নেত্রীর গাড়িবহরে হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি, ঘটার প্রশ্নই ওঠে না। আওয়ামী লীগের অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, আমি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী, দেশের যে কোন স্থানে এ ধরনের ঘটনার নিন্দা জানাই।’ স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপনের এই মন্তব্য সম্পর্কেও সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘বিষয়টি কি আসলেই তাই? তবে কি পত্রপত্রিকাগুলো যা লিখেছে আর প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলেছে তার সবই মিথ্যা?’ সেদিন শেখ হাসিনার গাড়িবহরের ওপর হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। এসব সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিলো।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রায় ৪৪ বছরের। দলটির সভাপতি হিসেবে তিনি এই দীর্ঘসময় নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতি ১৯ বছরের। বাকি সময় রাজপথের রাজনীতিতে। হামলা-মামলা-জেল-জুলুমসহ মৃত্যুকে তাড়া করছে সেই ’৮১ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই। এ সময় ২১ বার হত্যাচেষ্টা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় প্রতিবারই তিনি রক্ষা পান। তিনি কেন প্রতিপক্ষের টার্গেট? কারণ, শেখ হাসিনা পিতার মতোই অসীম সাহসী, দৃঢ়তায় অবিচল, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন আদর্শবাদী নেতা। দেশের যে কোনো সংকটে তার নেতৃত্ব মানবিকতার পরিচয় দেয়। সেখানে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। বাঙালি এই নারী পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে দুঃসহ স্মৃতির রক্তক্ষরণকে জয় করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; লড়াই করছেন সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। আজ বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তিনি জনগণের কাছে নন্দিত।
মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যার মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কারণে বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ আজ কার্যকর কল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্র। শেখ হাসিনা সরকারের প্রবর্তিত সামাজিক সুরক্ষা বলয় গোটা উন্নয়নশীল বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে লাখ লাখ গৃহহীন, ঠিকানাহীন মানুষের নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছেন জাতির পিতার কন্যা। তাঁর সুদক্ষ, সাহসী নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক সাফল্যে মিয়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা জয় করেছে বাংলাদেশ। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এর ফলে নিজ ভূমিতে পরাধীন মানুষ নাগরিক অধিকার পেয়েছে।
শেখ হাসিনা পরপর তিনবার দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা জানেন রাজনীতি মূলত নীতি ও কৌশলের খেলা। জঙ্গীবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে কৌশলে শতভাগ সফল হয়েছেন তিনি। প্রতিনিয়তই এক অস্থির রাজনীতি মোকাবিলা করে চলছেন। যাকে বলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান সততা, দক্ষতা আর জনগণের ভালোবাসা দিয়ে। সেজন্য ক্ষমতার রাজনীতির পাশাপাশি নীতিবোধের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বেঁচে আছেন বলেই বাঙালির স্বপ্নপূরণের অবলম্বন তিনি। তিনি দীর্ঘজীবী হোন, এই প্রার্থনা বিধাতার কাছে।
লেখক : দুলাল আচার্য, সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)