ইতিহাসের শিক্ষা ও শিক্ষা বাণিজ্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগের ঘটনা বলছি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সবে নবাব হয়েছেন। আলীবর্দী খাঁর জীবনাবসান হয়েছে। সিরাজ নবাব হওয়ার আগে থেকেই লক্ষ্য করেছেন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই তার শত্রু। শত্রুদের মধ্যে অন্যতম তার মায়ের বড় বোন ঘসেটি বেগম। মীরজাফর, ঘসেটি বেগম এবং ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ অবিরাম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ঘসেটি বেগম নানা ধরনের স্বেচ্ছাচারেও লিপ্ত ছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এক সময় দু'জন সেনাপতি দিয়ে ঘসেটি বেগমকে বন্দি করে আলীবর্দী খানের ঘরে নজরবন্দি করে রাখেন এবং ঘসেটি বেগমের মতিঝিল প্রাসাদ থেকে প্রাপ্ত যে সম্পদ সরকারি ভান্ডারে জমা দেওয়া হয়, তা ছিল মূল্যবান অলংকারাদি ছাড়াও নগদ চার কোটি টাকা, ৪০ লাখ মোহর, এক কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত জিনিসপত্র। সিরাজউদ্দৌলা এসব সম্পদ ট্রেজারিতে জমা দেন। এ ছাড়া ঘসেটি বেগম সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সেনাপতিদের প্রচুর টাকা ঘুষও দিয়েছিলেন। এই টাকার উৎস কিন্তু বাংলা।রোববার (২৮ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাংলার নায়েবে নাজিম ছিলেন ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজিশ মোহাম্মদ খান। নওয়াজিশ মোহাম্মদ খান এবং ঘসেটি বেগম কখনও ঢাকায় আসেননি। তাদের দেওয়ান এবং ঘসেটি বেগমের প্রণয়ী রাজবল্লভকে দিয়ে রাজস্ব আদায় করে একটি অংশ আত্মসাৎ করে বাকিটা ঘসেটি বেগমকে দিয়ে দিতেন। পরে পুত্র কৃষ্ণবল্লভ তার সঙ্গে যুক্ত হয়। কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে এ অর্থ ব্যয় হয়নি; সবটাই গিয়ে জমেছে ঘসেটির ভান্ডারে। আর সিরাজের মৃত্যুর পর একটা বড় ঘুষের ঘটনা ঘটায় মীরজাফর। মীরনকে নবাব বানানোর জন্য ক্লাইভকে এক কোটি ৬৯ লাখ টাকার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তখন কোষাগারে এক টাকাও ছিল না। তাই পুরো টাকা দেওয়া যায়নি। তবে কোটির বেশি টাকা দিয়ে নবাবি প্রার্থনা করেন। অবশ্য মীরণকে নবাবি দিতে হয়নি। এর মধ্যেই সে মৃত্যুবরণ করে। একদিকে লুণ্ঠন অন্যদিকে ঘুষ প্রদান। এসব যথেচ্ছাচারে যারা লিপ্ত ছিল, তারা কেউই ভোগ করতে পারেনি। মুর্শিদাবাদের রাজভান্ডারের অর্থসম্পদ লুটপাট করে প্রচুর ঘুষের টাকা ইংরেজ শাসক, কর্মচারীরা নিজ দেশ ইংল্যান্ডে পাচার করে দেয়।

দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করার রীতি বহু পুরোনো। কিন্তু তখন বিদেশিরা পররাজ্য গ্রাস করে নিজের দেশে টাকা পাঠিয়ে দিত। এসব ঘটনা বর্ণনা করার একটা গুরুতর কারণ আছে। বর্তমানে দুর্নীতির অর্থের যে শতকোটি টাকা তা কোথায় যায়, কোথায় থাকে? তিনশ কোটি টাকার জন্য কতগুলো ব্রিফকেস বা স্যুটকেস লাগে? হাজার টাকার নোট হলেও কতটুকু জায়গা লাগে? এই যে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের ৩২০০০ চাকরি হবে, তার জন্য একজন শিক্ষক পদের জন্য আট লাখ টাকার ঘুষ ঘোষণা হয়ে গেছে- এমন অভিযোগ শোনা যায়। এই টাকা কেউ একা খাবেন না। একা খেতে গিয়ে অনেকেই ঝামেলায় পড়েছেন। অন্যরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ধরিয়ে দিয়েছে। দুর্নীতিতে ধরা পড়ার যে ঘটনাগুলো ঘটে, তার কারণই হচ্ছে বঞ্চিত কেউ গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে। পলাতকরাই বা ধরা পড়ে কী করে? সাক্ষীদের বিশ্বাসঘাতকতাই তার কারণ। ৩২০০০ শিক্ষকের জন্য ৮ লাখ করে ঘুষ হলে কত কোটি টাকা দাঁড়ায়?

আমার মাথা গরম হতে শুরু করেছে। অঙ্কে পারদর্শী বন্ধুর কাছ থেকে জানলাম, টাকার অঙ্ক বেশি কিছু নয়; ২৫৬০ কোটি। এই টাকার একটা সুষম ভাগাভাগি হয়। এত গোপনে এবং সুচারুভাবে যে, তাতে কারও কোনো অভিযোগ থাকে না। দশজন ভালো লোক একটা ভালো কাজ করতে গেলে কাজের প্রক্রিয়া নিয়ে একটা গোলমাল লেগে যায়। কিন্তু এই ২৫৬০ কোটি টাকা নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। এ টাকা অবশ্য ঘসেটি কিংবা মীরজাফরের দুর্নীতির টাকার বেশি নয়। যখন টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত তখন ৪০০ কোটি বা ১৬৯ কোটি টাকার মূল্যমানের চেয়ে বেশি নয়। এক বাস মালিকের কথা মনে পড়ে গেল। বহুদিন আগে বলেছিলেন, আমেরিকায় ৩১ ডিসেম্বরে যত লোক মারা যায়; বাংলাদেশে, সারাদেশে তত লোক কি মারা যায়? সেই বাস মালিকের কথা অবশ্য এখন খাটে না। কারণ সেই সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গেছে। একটু আগে শুধু প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরির ঘুষের কথা বললাম। কারণ মানুষ গড়ার কারিগররা ঘুষ দিয়ে চাকরি করে একটা পুরো প্রজন্মকে ঘুষে অনুপ্রাণিত করবেন। নিজেরাও নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ওই আট লাখকে কোটিতে রূপান্তর করবেন।

শিক্ষা বাণিজ্য এখন একটা প্রচলিত শব্দ। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই জানেন। এক সময় একজন শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষা সচিব এ দুর্নীতির ব্যাপারে সচেতনমূলক কিছু কাজ করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থীরাও চাকরি পাচ্ছেন না। বছরের পর বছর চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে জীবন ও যৌবন দুই-ই শেষ করেছেন। অথচ তাদেরই সামনে টাকা দিয়ে সব জায়গায় চাকরি মিলে যাচ্ছে। কী নৈরাজ্য! ব্যবস্থা কি করা যায়? নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য যদি একটা কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য; তাদের কাজ হবে চাকরি পাওয়ার বিষয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং ঘুষ দিয়েছেন কিনা এটা বের করা। কাকে ঘুষ দিয়েছেন তাকে খুঁজে বের করে পুরো চ্যানেলকে বের করে ফেলা। এর মধ্যে থানা শিক্ষা অফিসারের সহকারী থানা শিক্ষা অফিসের একজন অত্যন্ত মারাত্মক কর্মকর্তা। তাদের কেউ কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরেন, বিভিন্ন স্কুল থেকে ৫ লিটার তেল নেন, দুপুরে খান এক জায়গায় এবং খাবারের টাকা নেন সব জায়গা থেকে। তিনি দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, জানা গেছে তাদেরও অনেকেই এ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। এদের নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনো কাজে কোনোভাবেই যুক্ত না করা উচিত। তারাও হয়তো নিয়োগ পেয়েছেন দুর্নীতির মাধ্যমে।

ইউনেস্কোর একটি প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে তাদের যে ভ্রমণ-সংক্রান্ত ভাউচারের সন্ধান পেয়েছি, তাতে শিক্ষার এসব কর্মকর্তা থাকা একেবারেই সমীচীন নয় বলে আমি তখনই বলেছিলাম। তখনকার সচিবরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। ক্ষমতার পালাবদলে নানাভাবে অনেকেই নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের পরিবর্তন করাও হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এবার যাতে ওইসব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা সুযোগ না পান, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব কঠিন নয় কাজটা। নিয়োগউত্তর ব্যবস্থাটা নিতে হবে। যারা আট লাখ টাকা দিয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হবে না। এখন প্রাইমারি শিক্ষকরা অনেক টাকা বেতন পান। তাদের নিয়োগের সুস্থতা অনেক জরুরি।

ফিরে আসি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি; তার সঙ্গে কেন সেই তিনশ বছর আগের ঘটনা যুক্ত করলাম। ঘসেটি বেগম বা মীরজাফর আলী খান ইংরেজদের কাছে দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন এবং উৎকোচের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ। তাদের সে কর্মের পরিণাম আমরা আজও ভোগ করছি। যারা শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতি করেন তারা নিজেদের স্বার্থে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটা সুদূরপ্রসারী অভিশাপ ডেকে আনছেন।

শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ বাণিজ্য একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। যদিও প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দুর্নীতিটি অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে কভিড-১৯ এর মতো একটি মহামারির ফলে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে দুটি মূল্যবান বছর নষ্ট হয়ে গেছে। করোনার দুর্যোগকালে অসাধু ব্যবসায়ীদের মতো যদি দুর্নীতিবাজরা এই ৩২০০০ শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে এসব লোক মীরজাফরের চাইতে কম অপরাধী নয়। এই অপরাধীদের শায়েস্তা করতে গেলে শুধু সরকারি ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়; সামাজিকভাবে এদের প্রতিরোধ খুবই প্রয়োজন। এদের মীরজাফরের মতোই সামাজিক ঘৃণা প্রাপ্য।

লেখক : মামুনুর রশীদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024228096008301