ঈদ আসে ঈদ যায় এমপিওভুক্তদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না!

অধ্যাপক মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ |

আমারো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অনেক আশা ও অফুরন্ত সম্ভবনার হাতছানিতে মানুষ গড়ার কারিগড় হয়েছি। বদলি না থাকায় প্রায় বত্রিশ বছর এক কলেজ, একই চাকরিতে আছি। এখন শুধু অবসরের দিন গুণে অপেক্ষা করছি। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে- অভাব, অসুস্থতা, অনিশ্চয়তা! নিজের মধ্যেই নিজে হয়ে উঠি আশরাফ সিদ্দিকীর বিখ্যাত কবিতার চরিত্র। পরিচয়টা এমন:  

‘যদিও করছি লেন নয় শিক্ষার দেন
(মাফ করবেন! নাম শুনেই চিনবেন)
এমন কথা কেমন করে বলি!
তবুও যখন ঝাড়তে বসি স্মৃতির থলি
মনে পড়ে অনেক অনেক কচি মুখ,


চপল চোখ:

শুনুন: গর্বের সাথেই বলি:

তাদের ভেতর অনেকেই এখন বিখ্যাত লোক!’

শরীর-মন যখন বেশি খারাপ হয়, যখন পেশাগত কষ্ট কুড়ে-কুড়ে খায়- রাতের ঘুম দিনের সম্মান যখন অনিশ্চয়তার হাহাকারে হারাই; তখন আশরাফ সিদ্দিকীর ‘তালেব মাস্টার’ কবিতার কয়েকটি লাইন অন্তরের অন্তস্থলে আনমনে উচ্চারিত হয়:

‘অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে আমার
পিঠ বেঁকে গিয়েছে আর
চোখেও ভালো দেখি না তেমন
তাই ভাবছি: সময় থাকতে থাকতে এখন
আত্মকাহিনীটা লিখে যাবো আমার!
.........আপনি কি এমন একটি

কাহিনী শুনেছেন:

কোথাও রোমাঞ্চ নেই! খাঁটি করুণ বাস্তবতা

এবং এই বাংলাদেশেরই কথা!

.....পানির মতো বছর কেটে গেল

কত ছাত্র গেল, এল-

প্রমোশন পেল

কিন্তু দশ টাকার বেশি প্রমোশন হয়নি

আমার!

ইতিহাস সবই লিখে রেখেছে। রাখবে-
কিন্তু এই তালেব মাস্টারের কথা কি লেখা
থাকবে?

আমি যেনো সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা
আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু
নিজের জীবনই অন্ধকারমালা।’

একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের জীবনে ঈদ সবসময়ই বিবর্ণ ও হতাশার। এবারের ঈদুল ফিতরেও বার বার মনে হয়েছে; ঈদ আসে ঈদ যায় এমপিওভুক্তদের উৎসব ভাতার চাকা ঘোরে না! ‘জাতীয়লজ্জা’ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসবভাতা! দেশের প্রায় ৯৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি।  অথচ বেশিরভাগ এমপিওভুক্ত শিক্ষক নানান বঞ্চনা শিকার। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতন স্কেলের শতভাগ সরকারিভাবে বহন করা হয়। অনেক দেনদরবার করে অবশেষে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে চালু হয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতনের ২৫ শতাংশ উৎসবভাতা।  আর এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ। বিশ বছর ধরে কোনো উন্নতি নেই। শতভাগ উৎসব ভাতা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাণের আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক সম্মান নিয়ে বাঁচার দাবি। ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে অত্যন্ত বেমানান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কি ‘এক- চতুর্থাংশ উৎসব’ পালন করবেন? অতৃপ্তি, আত্মগ্লানি ও অসম্পূর্ণতার হাহাকারে চার আনা উৎসব ভাতায় ষোল আনা উল্লাস অসম্ভব!

সরকারি বেতনস্কেল অনুযায়ী স্নাতক পাস একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এরই সিকি ভাগ উৎসব ভাতা হিসেবে পান ৩ হাজার ১২৫ এমন বাস্তবতায়, তিনি যে কতোটা অসহায় তা বলা বাহুল্য। বাংলাদেশের অপর কোনো পেশায় ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা নেই। আশায় থাকছি, আগামী ঈদুল আজহার আগেই এমপিওভুক্ত শিক্ষক সমাজের উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

আমরা জানি, সরকারের সদিচ্ছা আছে এবং আছে সীমাবদ্ধতাও। প্রয়োজনে একধাপে সম্ভব না হলে পর্যায়ক্রমে হলেও এমপিওভুক্তদের উৎসব ভাতা শতভাগে উন্নীত করা সম্ভব ও যৌক্তিক। দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৪০-৪৫ শতাংশ বা বেশি পান। এমপিওভুক্তদের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পদের (অফিস সহায়ক থেকে প্রিন্সিপাল) সবাই একই পরিমাণ বাড়িভাড়া পান। তারা পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ও উৎসব ভাতা, সেচ্ছা অবসর, বদলি সুবিধায় বঞ্চনার শিকার।  তাদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত ও শর্তযুক্ত। ‘সহ’ ‘উপ’ ‘যুগ্ম’ ‘সাব’ ‘জুনিয়র’ ইত্যাদি পদবির চূড়ান্তধাপে পূর্ণ-পদবিধারী থাকেন। এমপিওভুক্ত কলেজে সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপকের পদ না থাকায় জিজ্ঞাসা, ‘সহকারী অধ্যাপকরা’ ঊধ্র্বতন কর্মকর্তার সহকারী? এমপিওভুক্ত কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ হতে হলে প্রার্থীকে নতুন করে চাকরি খুঁজতে হয়। আছে নানান শর্তের জটিল বেড়াজাল। চাকরি পেলে ছাড়তে হয় আগের পদ। কীভাবে সম্ভব এমপিওভুক্তদের পক্ষে ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া বাবদ পেয়ে গ্যাস, বিদ্যৎ, ওয়াইফাই, ডিস, রাতের পাহারাদার, ময়লা ফেলা আরো নানান দেনা শোধ করা!

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিস সম্মেলনে ১৩টি অধ্যায় ও ১৪৬টি ধারা-উপধারায় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য প্রণীত সুপারিশে শিক্ষকের চিকিৎসা- স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি বেতন-ভাতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বলা আছে (ক) সম্মানজনক পারিতোষিক নিশ্চিতকরণ (খ) যুক্তি সংগত জীবনমান বিধানকল্পে সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ (গ) স্কেল অনুযায়ী নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা (ঘ) জীবনধারণের ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাস ও বর্ধিতবেতন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ইত্যাদি। ‘মানুষ গড়ার কারিগরদের জীবনমান অনুন্নত থাকলে, কারিগরকে অভুক্ত, অবহেলিত রাখলে জাতি হয়ে উঠবে অবনমিত ও নিম্নগামী। রূঢ় সত্য হলো, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র বেতন বেশি অথচ শিক্ষকের বেতন ও সুযোগ সুবিধা কম, অন্যদিকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র বেতন কম অথচ শিক্ষকের বেতন ও সুযোগ সুবিধা বেশি!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের মহাসড়কে দারুণ অনগ্রসর ও করুণ পেশাজীবীর অখ্যান ‘বেসরকারি শিক্ষক’। ঐসব মানুষদের আকাঙ্ক্ষা ও অপেক্ষা অনন্ত হাহাকার হয়ে শূন্যে মেলায়! আশা ছিলো, এবারের ঈদের আগেই বেসরকারি শিক্ষকদের ব্যাপার সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকবে। মাঠে-ময়দানে অনুগত ও সুবিধাভোগীদের মুখে আশার বাণী শোনা যাচ্ছিলো! কিন্তু ঘুরেনি ভাগ্যের চাকা! 

এক ঘোষণায় সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ জরুরি। লাখ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার এবং সর্বস্তরের নন- এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা মাদার অব হিউমিনিটি খেতাবধন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো সুরঙ্গমুখে আলোর ঝিলক দেখা যাবে সহসাই!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024988651275635