সাত শিক্ষকসহ নয়জনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
একটি মামলায় প্রায় সাড়ে ৬ মাসের তদন্ত শেষে এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। পিবিআই সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারা হলেন রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক (দিবা শাখা, বাংলা মাধ্যম) বিতর্কিত ও সাংবাদিক কার্ড বিক্রি চক্রের হোতা মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী শিক্ষক ফয়সাল শামীম, সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, কো-অর্ডিনেটর তরিকুল আজম খান, শরীরচর্চা শিক্ষক প্রীতিশ কুমার বিশ্বাস, সিকিউরিটি গার্ড জিয়াউল হক জিয়া ও মাসুদ রানা।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম সামসুল আলমকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আ ন ম সামসুল আলম বলেন, আমি আমার দায়িত্ব পালনে কোনো রকম উদাসীনতা করিনি। তিনি কী কারণে আমাকে অভিযুক্ত করলেন, তা আমার জানা নেই। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসাবে এর বাইরে আমার বলার কিছুই নেই।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই সেশনে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক শাখার গভর্নিং বডির নির্বাচিত সদস্য ছিলেন শফিকুর রহমান। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। মেয়ে তাসরিফা রহমান বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখায় অধ্যয়নরত। আর ছেলে তাইফুর রহমান নাহিয়ান বর্তমানে দশম শ্রেণিতে পড়ছে।
শফিকুর রহমান ২২ ফেব্রুয়ারি শিশু নির্যাতন দমন আইনে আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, গভর্নিং বডির সদস্য থাকাকালে ওই প্রতিষ্ঠানে সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে নানা উদ্যোগ নেন তিনি। এ কারণে শিক্ষক ও কর্মচারীদের একটি মহল তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে শফিকুর রহমানের ছেলে তাইফুর রহমান নাহিয়ানকে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনসহ নানানভাবে নাজেহাল করতে থাকেন তারা। তাকে স্কুলবিমুখ করার উদ্দেশ্যে নানাভাবে মানসিক চাপ তৈরি করা হয়।
কারণে-অকারণে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখা, ছোট করে কথা বলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, পরীক্ষার খাতায় নম্বর কেটে দেওয়ার হুমকি, স্কুলে নিয়মিত এলেও অনুপস্থিত দেখিয়ে অভিভাবককে এসএমএস প্রদানসহ নানাভাবে নাজেহাল করা হয়।
শফিকুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে প্রথমে অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলমের কাছে মৌখিক অভিযোগ, এরপর লিখিত অভিযোগ জানাই। কোনো প্রতিকার না পেয়ে রমনা থানায় একটি জিডি করি। এরপর উপায়ন্তর না দেখে আমি আদালতে মামলা করি।
তিনি বলেন, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গুটিকয়েক শিক্ষক-কর্মচারীর কারণে এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে-এমনটা কাম্য হতে পারে না। তিনি বলেন, আমি চাই, এই স্কুলের শিক্ষক যারা থাকবেন, তারা মানবিক হবেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-এর ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের এসআই জামান মাতুব্বর বলেন, ২১ মার্চ মামলাটির তদন্তভার পিবিআই-এর হাতে ন্যস্ত হয়। এরপর টানা সাড়ে ৬ মাস ওই মামলার তদন্ত করি।
তদন্তে উঠে এসেছে, মামলার বাদী শফিকুর রহমান গভর্নিং বডির সদস্য থাকাকালে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর বাংলা মাধ্যম দিবা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে তার স্কুল অফিস কক্ষে ইংরেজি মাধ্যম দিবা শাখার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাহবুব মাহাদি ও দ্বীপ কান্তি শিংকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শফিকুর রহমান। তদন্তে শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়ায় শিক্ষক নাসির উদ্দিনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করা হয়। এই কারণে নাসির উদ্দিন ও তার সহযোগীরা তাইফুর রহমান নাহিয়ানের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্টিমরোলার চালান।
পিবিআই-এর তদন্ত কর্মকর্তা তার মতামতে উল্লেখ করেছেন, মামলাটি প্রকাশ্যে ও গোপনে তদন্তে, গ্রহণকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণে, কাগজপত্র পর্যালোচনা এবং সর্বোপরি ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় পিবিআই জানতে পারে, বাদী শফিকুর রহমান গভর্নিং বডির সদস্য থাকাকালীন শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বেশকিছু সৃজনশীল কাজ করেন, যা ওই প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও অফিস স্টাফের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের পরিপন্থি হওয়ায় ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে তার ছেলে শিশু তাইফুর রহমান নাহিয়ানকে স্কুলবিমুখ করার অপচেষ্টা হিসাবে তাকে কোনো কারণ ছাড়াই ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখা, অন্য শিক্ষার্থীদের সামনে হেয় করা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, স্কুল গার্ডদের দ্বারা গমনাগমনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
এতে নাহিয়ান মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে খাওয়াদাওয়া বন্ধসহ অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। ফলে বাদী তাকে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন।