উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমকালীন চ্যালেঞ্জ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে? দেশে স্বায়ত্ত্বশাসিত, পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। আরও নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন ও অনুমতি পাচ্ছে। এই বঙ্গের প্রথম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে শতবর্ষ পার করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ বছর এবং চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও অর্ধশতবর্ষ পার করেছে। এগুলো ঘিরে গড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থারও বয়স বাড়ছে বৈকি। ফলে সামনের দিনগুলোতে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে এগোবে- এ প্রশ্ন খুবই সংগত। শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, আমি মনে করি, এগোতে হবে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবেই। সেটাই দাঁড়াবে প্রধান ও প্রাথমিক দায়িত্ব। তার জন্য প্রয়োজন হবে বিতরণের লক্ষ্যে জ্ঞান আহরণ ও সৃষ্টি। জ্ঞানের সৃষ্টি হয় গবেষণার মধ্য দিয়ে। তাই গবেষণা চাই। গবেষণাকে হতে হবে মৌলিক তো অবশ্যই; সেই সঙ্গে উপযোগীও। আর গবেষণার ফল প্রকাশ করার দরকার পড়বে। তার জন্য চাই প্রকাশনা। বস্তুত, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনতে হলে সেখানে কী ধরন ও মানের গবেষণা হচ্ছে, সেটা যেমন দেখতে হয়; তেমনি খোঁজ নিতে হয় তার প্রকাশনারও।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অবশ্য একটি বড় ও বিশেষ রকমের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সেটা হলো, বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা দান। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুধু যে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে চেয়েছে, তা-ই নয়; আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলা ভাষা হবে উচ্চ আদালতের ভাষা এবং অবশ্যই সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম। এ দুটির কোনোটাই অর্জিত হয়নি। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান শুধু আত্মসম্মান রক্ষার ব্যাপার নয়; যথার্থ শিক্ষার ব্যাপারও বটে। এটা তো সবাই জানেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে না দিলে শিক্ষা গভীর ও স্থায়ী হবে না; আসলে যথার্থই হবে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেরও কর্তব্য রাষ্ট্রকে দায়িত্বসচেতন করে তোলা এবং নিজের দিক থেকেও উদ্যোগী হয়ে দায়িত্বটি গ্রহণ করা।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সমাবর্তনের কথা বলা যেতে পারে। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। পরপর দুটি সমাবর্তন দুই দিনে, ৮ ও ৯ মার্চ ১৯৭০-এ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় সমাবর্তনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা। তিনি তাঁর বক্তৃতায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন- 'যে সকল দেশ আজ শিল্প ও বিজ্ঞানে উন্নত তাদের সকলে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে পরিশেষের স্তর পর্যন্ত শিক্ষার বাহন মাতৃভাষায় রেখেছে। আমরা আশা করেছিলাম বিভাগোত্তর দেশে এ বিষয়ে আমরা সর্বগ্রাসী হয়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও যাবতীয় অন্য বিষয়ে শিক্ষা ত্বরান্বিত করতে পারব।'

পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনে ওই লক্ষ্য অর্জন যে অসম্ভব ছিল- তার প্রমাণ তো তখনকার ইতিহাসেই লেখা রয়েছে। জোর দিয়ে কুদরাত-এ-খুদা বলেছেন, 'বাংলার সুধীবৃন্দের আজ শুধু প্রয়োজন তাদের শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান, কলা, কৌশল, ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষার জন্য নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। আমার বিশ্বাস, কাজ যথেষ্ট সহজ হয়ে উঠবে। বিভাগোত্তর যে ভীতি এরূপ পুস্তক প্রণয়নের পথে দেখতাম, আজ তা দেখি না। আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে আমরা পাঠ্যপুস্তক না দিলে তারা চিরকাল বাইরের দিকে চেয়ে থাকবে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য। পরমুখাপেক্ষিতা জাতীয় জীবনের জন্য অভিশাপ। এর থেকে মুক্তি লাভ করা আশু প্রয়োজন।' উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষায় সমাবর্তন বক্তৃতাদান ওটাই ছিল প্রথম।

বাংলা ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার খুব বড় রকমের একটা দুর্বলতা- দুর্বলতা নয় অভিশাপই; তিন ধারার যে বিভাজন, তার হাত থেকে অব্যাহতি লাভের দিকেও আমরা অগ্রসর হতে পারব। তিন ধারাকে এক ধারায় (অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে) না আনলে শিক্ষার মধ্য দিয়ে শ্রেণি বিভাজনকে পোক্ত ও গভীর করার যে আত্মঘাতী কাজ আমরা করে চলেছি, তা থেকে যে মুক্তি নেই- এ কথাটা তো আর বাড়িয়ে বলার দরকার পড়ে না।
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক জীবনকে উজ্জীবিত করা। এ জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে ছাত্র সংসদের বার্ষিক নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকেও নিয়মিত উৎসবে পরিণত করা চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ যে সন্তোষজনক নয়- সেটিও ভুললে চলবে না। পরিবেশের দুর্বলতা বিষয়ে অভিযোগ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়; সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই যেহেতু প্রথম ও প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়; তাই পরিবেশ উন্নয়নে নেতৃত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই দিতে হবে। এটি তার জন্য ইতিহাস-নির্ধারিত কর্তব্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিষয়ে বড় রকমের দুটি অভিযোগ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চ্যান্সেলর, যিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি, তিনি নিজেই করেছেন। প্রথমটি এ রকম- 'সম্প্রতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অমানবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জনের জন্য; লাশ হয়ে বা বহিস্কৃত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নয়।' তাঁর দ্বিতীয় অভিযোগটি এ রকম। তাঁর মতে, 'এক শ্রেণির' শিক্ষক নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশু কর্তব্য। তিনি এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। সুতরাং এর জবাবদিহি জনগণের কাছে।'

আমরাও আশা করব, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও সংস্কৃতি উভয় ক্ষেত্রেই দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজেই নিজের গৌরবান্বিত ইতিহাসকে অতিক্রম করে যাবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজেরও দায়িত্ব থাকবে। একটা দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আগ্রহী থাকা। সে আগ্রহ নানাভাবেই প্রকাশিত হতে পারে। এমনকি শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমেও।

উচ্চশিক্ষার চ্যালেঞ্জ কিন্তু আরও আছে। সেটা বৈশ্বিক ও বৈপ্লবিক। নাম তার চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই বিপ্লব উৎপাদনশীলতার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটাবে এবং পৃথিবী ভরে যাবে প্রাচুর্যে। এর কেন্দ্রে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রশ্ন হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তার সৃষ্টিশীলতার মালিকানা থাকবে কাদের হাতে? আগের সব বৈপ্লবিক অবদানের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে, তেমনি মালিকানা অল্প কিছু সুবিধাভোগীর হাতেই কি থাকবে, বাকি মানুষদের বঞ্চিত করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে মানুষের হৃদয়ের স্থানটা হবে কোথায়? হৃদয় কি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধির?

প্রশ্ন দুটি আসলে চ্যালেঞ্জই। এখানে বিশ্ববিদ্যালগুলোর কর্তব্য থাকবে। সেটা হলো, মনুষ্যত্বকে রক্ষা করা। তার জন্য প্রয়োজন মানববিদ্যার চর্চা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি অপরিহার্য। কিন্তু মানববিদ্যার চর্চা যাতে সংকুচিত না হয়; সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদির সৃষ্টিশীল চর্চা যাতে গুরুত্ব না হারায়; সেটা দেখা সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই কর্তব্য। বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া চাই ইতিহাস ও সাহিত্যকে, যে দুটি বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে জ্ঞানার্জন কখনোই পরিপূর্ণ হয় না।

লেখক:সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031561851501465