উদ্ধার হয়নি নিখোঁজ তিন কলেজছাত্রী, গ্রেফতার চার

নিজস্ব প্রতিবেদক |

রাজধানীর পল্লবী থেকে বহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া তিন কলেজছাত্রীকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে তারা আর ফেরেনি। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।

নিখোঁজ তিনজনের মধ্যে একজনের মা মাহমুদা আক্তার শুক্রবার পল্লবী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। তাঁর অভিযোগের পর থানায় এনে অন্য চার শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর গতকাল রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পালিয়ে যেতে এবং কৌশলে পাচারে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরো সাত-আটজনকে আসামি করা হয়েছে। 

মাহমুদা অভিযোগ করেছেন, এই চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে নিখোঁজ তিন ছাত্রীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও টিকটক গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। তাদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে এই চারজন জানতে পারে। তবে চার শিক্ষার্থী এ বিষয়ে কিছু জানে না বলে দাবি করছে।

পল্লবীর যে এলাকা থেকে তিন ছাত্রী নিখোঁজ হয়েছে, গতকাল সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর নিলে কেউ কিছু বলতে পারেনি। এলাকার লোকজন জানায়, তারা ঘটনা শুনেছে।

পল্লবী থানায় গিয়ে দেখা গেল, নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের একজনের বোন পুলিশের এক উপপরিদর্শকের কাছে অনুনয় করে বলছিলেন, ‘যেমনে পারেন স্যার আমার বোনকে ফিরিয়ে দেন। আমার বোন সহজ-সরল ছিল, নারী পাচারকারী বা টিকটক চক্রের কেউ আমার বোনকে মিথ্যা প্রলোভনে ফেলে কৌশলে অপহরণ করেছে।’

পুলিশ বলছে, তারাও মানবপাচারকারী ও টিকটক চক্রকে সন্দেহের মধ্যে রেখেই তদন্ত করছে।  

পল্লবী থানার পুলিশ ছাড়াও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সব সংস্থা ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। তারা তিন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করতে সব ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। 

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা গতকাল বিকেলে বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের পাশাপাশি টিকটক চক্রসহ সম্ভাব্য অপহরণকারী চক্র জড়িত কি না তদন্ত চলছে। এর আগে টিকটক চক্র ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নারী পাচার করেছিল। নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থীর মধ্যে স্নেহা নামের মেয়েটি ছিল খুবই উচ্চাভিলাষী। ধারণা করা হচ্ছে, তার সঙ্গে টিকটক চক্রের যোগাযোগ রয়েছে। সে-ই অন্য দুই শিক্ষার্থীকে কৌশলে সঙ্গে নিয়ে পাচারকারীদের সঙ্গে লাপাত্তা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার কাজী দিলখুশ জান্নাত নিসা, কানিজ ফাতেমা ও স্নেহা আক্তার পল্লবীর ১১ নম্বর প্যারিস রোডের ‘সি’ ব্লক ১৮ নম্বর লাইন এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়। তারা সবাই উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে জান্নাত নিসা মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট, স্নেহা পল্লবী ডিগ্রি কলেজ ও কানিজ ফাতেমা দুয়ারীপাড়া কলেজের ছাত্রী। তারা একে অন্যের বান্ধবী।

জান্নাত নিসার মা মাহমুদা আক্তার পল্লবী থানায় শুক্রবার লিখিত অভিযোগ করার পর তরিকুল ও তার ভাই রকিবুল, অয়ন ও জিনিয়া নামের চার শিক্ষার্থীকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময়ও তারা থানায় ছিল।

অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থী এখনো উদ্ধার হয়নি। অভিযান চলছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন যে নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থীর বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে তারা কোথায় গেছে বা আছে, সে খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।

পল্লবী থানায় তিন শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের পাশাপাশি থানায় ডেকে আনা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকও ছিলেন। নিখোঁজ জান্নাতের বড় বোন কাজী রওশন দিল আফরোজ  বলেন, তাঁর বোন ও তার দুই বান্ধীকে বিদেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখানোর কারণে তারা পরিকল্পনা করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে তিনজনই কলেজের পোশাক পরে, কাঁধে কলেজের ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হয়েছে। তাদের উধাও হওয়ার পেছনে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের হাত থাকতে পারে। তিনি দাবি করেন, “আটক তরিকুল আমার বোনের সঙ্গে প্রায় সময় কথা বলত। তরিকুল তাকে (নিসা) বলত, সে অনেক বড় হ্যাকার, আর অনেক বড় কম্পানির মালিক। আমেরিকায় লোক পাঠায়। আমার বোন নিসা বাসায় এসে আমাকে প্রায় সময় বলত যে ‘আপু, তরিকুল তোমাকে তার কম্পানির লিগ্যাল অ্যাডভাইজার পদে চাকরি দেবে।’ তরিকুলের টিকটক গ্রুপের বান্ধবী জিনিয়া। সে আমার ছোট বোন ও তার বান্ধবীদেরও পরিচিত। তিনজন নিখোঁজ হওয়ার পর জিনিয়ার বাসায় গিয়েছিলাম ওদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। কিন্তু সে দেখা করেনি। রহস্যজনক কারণে তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে।”

দিল আফরোজ জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে বাসার সবাই ঘুমিয়ে ছিল। এ সময় তাঁর বোন দিলখুশ জান্নাত নিসাকে ফোন দিয়ে তাঁদের পল্লবী ১১ নম্বর সেকশনের ‘সি’ ব্লকের ১৮ নম্বর লাইনের ৭৯ নম্বর বাসার সামনে থাকতে বলে স্নেহা আক্তার। একই সময় কানিজ ফাতেমাকে সেখানে আসতে বলে। তাঁদের বাসার সামনে থেকেই তিনজন একসঙ্গে চলে যায়।

পল্লবী থানার উপপরির্শক (এসআই) সজীব খান দিল আফরোজের কাছে জানতে চান যে তাঁর বোন কোথায় যাচ্ছে জানতে চেয়েছিলেন কি না। জবাবে দিল আফরোজ বলেন, নিসা বলেছিল বান্ধবীদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। তিনি আরো বলছিলেন, টিকটক চক্রের কেউ বা অপহরণকারীচক্রের কেউ তাঁর বোনসহ তিন শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে দেশের কোথাও লুকিয়ে রেখেছে বা বিদেশে পাচার করেছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে দিল আফরোজ বলেন, তাঁর বোনের পাসপোর্ট নেই। তবে টাকা, স্বর্ণালংকার ও শিক্ষা সনদ সঙ্গে নিয়ে গেছে।

জান্নাত নিসার মা মাহমুদা  বলেন, ‘বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার মেয়ে ছয় লাখ টাকা, মেয়ের এক বান্ধবী তার বাসা থেকে আডাই ভরি সোনা ও আরেক বান্ধবী ৭৫ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ঘটনার পর আমরা তরিকুলের বাসায় গিয়ে তাকে ও তার বড় ভাই রকিবুলকে বাসায় পাইনি।’

সন্দেহভাজন জিনিয়া জামান রোজ বলে, সে মিরপুর ১৩ নম্বরের বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কানিজ ফাতেমা ও স্নেহা আক্তার তার স্কুলবন্ধু ছিল। তাদের মাধ্যমে দিলখুশ জান্নাত নিসার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিন্তু তারা কিভাবে নিখোঁজ হয়, এখন কোথায় আছে—তার কিছুই জানে না। জিনিয়া বলে, সে বৃহস্পতিবার তার মায়ের সঙ্গে ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল।

সন্দেহভাজন তরিকুল ও রকিবুলের মা রেহানা পারভীন বলেন, ‘আমার ছেলেকে কেন পুলিশ থানায় এনেছে জানা নেই, আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি।’

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059340000152588