একটি দেশের অর্থনৈতিক পণ্য উৎপাদন নির্ভর করে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ, মানুষের শ্রম, উৎপাদনের সাজসরঞ্জাম এবং ব্যবসায়ীদের ওপর। ধনতন্ত্র বলতে এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে অর্থনৈতিক পণ্য উৎপাদনের কাজে জটিল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় এবং যা ব্যবহারের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় শ্রমজীবী। কলকারখানাভিত্তিক অর্থনীতির আবির্ভাবের আগে শ্রমজীবী বলে কিছু ছিল না। তখন মানুষ শ্রম দিয়েছে নিজের ইচ্ছা অনুসারে। অপরের হুকুমে নয়। ক্ষেতমজুররা অবশ্য ক্ষেতখামারে কাজ করেছেন জমির মালিকের হুকুমে। শ্রমজীবী শ্রেণির উদ্ভব হতে পেরেছে যন্ত্র বিপ্লবের ফলে (মেকানিক্যাল রিভোলিউশন)। অর্থাৎ যখন থেকে যন্ত্র চলেছে বাষ্পশক্তি নির্ভর করে। বিলাতে প্রথম শুরু হয় এই যন্ত্রবিপ্লব। ইংল্যান্ডে কাঠ-কয়লার অভাব দেখা দিলে শুরু হয় পাথুরে কয়লার ব্যবহার।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব খাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, তাদের মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। এ খাতে প্রায় ৫ হাজার কারখানা রয়েছে, যেখানে ৩.৫ মিলিয়নেরও অধিক শ্রমিক কাজ করছেন। ২৫ বিলিয়ন ডলারের এ খাত জাতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ পূরণ করে থাকে (বিকেএমইএ ওয়েবসাইট)। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশের এই পোশাক খাতের ৮০ ভাগ শ্রমিকই হচ্ছে সমাজের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার নারী গোষ্ঠী, যাদের উল্লেখযোগ্য কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। বার্ষিক জিডিপি’তে এ খাতের অবদান ১৬ শতাংশ।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবী নিয়োজিত আছেন তৈরি পোশাক শিল্পে। এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমজীবীরা যদি ইচ্ছেমতো ধর্মঘট করে তৈরি পোশাকের দাম বাড়ান, তবে তা বিক্রি হবে না বিশ্ববাজারে। ফলে উঠে যাবে তৈরি পোশাক শিল্প। তৈরি পোশাকের চাহিদা খুবই নমনীয়। তাই তার দাম বাড়লে থাকছে বাজার হারানোর আশঙ্কা। ইংল্যান্ডে স্ট্রিম ইঞ্জিন ব্যবহার শুরুর পর থেকে কল-কারখানায় শ্রমিক নিয়োগ শুরু হতে থাকে। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জেমস ওয়াটের আবিষ্কৃত তাঁত চালানোর যন্ত্র স্ট্রিম ইঞ্জিন ব্যবহার শুরু হয়। এরপর জর্জ স্টিফেনশন ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে স্ট্রিম ইঞ্জিন ব্যবহার করেন রেলগাড়ি চালাতে (আগে ছিল ঘোড়া টানা রেলগাড়ি)। বাংলাদেশে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ১১১ মাইল রেলপথ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে এই রেললাইনে প্রথম রেলগাড়ি চলে। রেলকে কেন্দ্র করে এ দেশে প্রথম শ্রমিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এর আগে আধুনিক অর্থে এ দেশে শ্রমিক শ্রেণি ছিলো না। বিলাতে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বের মাধ্যমে শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে তাদের মজুরি বাড়াতে, কাজের পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে এবং শ্রমের সময় কমাতে আগ্রহী হতে থাকেন। ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ স্থাপন করেন লালা লাজপত রাই। ব্রিটিশ ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আইন পাস হয় ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে। এই আইন করা হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট’-এর অনুকরণে। এই উপমহাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করলে দেখা যায়, ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর প্রথম সমন্তিপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেন মজুরি ভিত্তির দাবিতে।
ধর্মঘট কথাটির একটি বিশেষ ইতিহাস আছে। এ দেশে নীলচাষিরা ধর্মঠাকুরের ঘটকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তারা নীল চাষ করবেন না। নীলচাষিদের আন্দোলনের সময় ধর্মঘট কথাটি উদ্ভব ঘটে। নীলচাষিরা ঠিক শ্রমজীবী ছিলেন না। তাদের দিয়ে নীল চাষ করানো হতো গায়ের জোরে। আসলে একসময় এ দেশে জমির সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেতমজুরদের খাটতে হয়েছে বেগার। তারা কোনো মজুরি লাভের অধিকারী ছিলেন না। অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে তাদের বলা চলে না শ্রমজীবী বা মজুর। কারণ তারা তাদের শ্রমের জন্য পেতেন না কোনো মজুরি। যারা নিজের শ্রমের জন্য কোনো মজুরি লাভ করেন না তাদের বলা চলে না মজুর বা শ্রমজীবী।
মজুর শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে। ফার্সিতে শব্দটি হলো মজদুর। ফার্সিতে কারখানা বলতে বোঝাত এমন জায়গা, যেখানে সম্রাট ও বিত্তবানেরা লোক নিয়োগ করে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করতেন। যারা কারখানায় জিনিস তৈরি করতেন তারা তাদের শ্রমের জন্য পেতেন মজুরি। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট নামক স্থানে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবিতে শ্রমিকেরা ধর্মঘটের আহ্বান করেন। শ্রমিকদের সভায় বক্তৃতা করেন অগাস্ট-স্পাইস। অগাস্ট-স্পাইস ছিলেন অ্যানার্কিস্ট। তিনি মনে করতেন শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদ না করতে পারলে। তিনি ছিলেন বিপ্লবী, গায়ের জোরে ধনতন্ত্রকে অবসানের পক্ষে। এই শ্রমিক সভায় মারামারি শুরু হয় পুলিশের সাথে। এসময় কোনো একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি পুলিশের ওপর হাতবোমা ছোড়ে। পরে জানা যায় শ্রমিকদের কেউ হাতবোমা ছোড়েননি। কিন্তু সে সময় প্রচারিত হয়েছিল শ্রমিকদের মধ্যে কেউ পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা ছুড়েছিল। আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে ১১ জন শ্রমিক নিহত হয় এবং আহত হয় আরও অনেকে। এটা হচ্ছে মে দিবসের মূল ইতিহাস। প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার কি আজও বাস্তবায়িত হতে পেরেছে? ৮ ঘন্টা কর্মদিবস হিসেবে পালনের রীতি কি আমরা মানতে পারছি? একটি নিয়ম হয়েছিল এবং এখনো প্রচলিত আছে, সেটি হলো ৮ ঘন্টার বেশি পরিশ্রম করলে অতিরিক্ত সময়ের জন্য ‘ওভারটাইম’ হিসেবে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই সকল রীতি-নীতি অনেকাংশেই ফসিল। এগুলোর বাস্তবিক প্রয়োগ একেবারে নেই বললেই চলে। শ্রমিকদের দিয়ে করিয়ে নেয়া হয় অতিরিক্ত পরিশ্রম।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বল্প উন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশ থেকে শ্রমিক ভাড়া নেয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও পড়ে। বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিদেশের মাটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়। প্রাপ্ত সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের এই বঞ্চনা শুধু বিদেশের মাটিতেই নয়। বরং দেশের মাটিতে আরো বেশি!
শরীরের রক্ত পানি করে, হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও শ্রমিকের মনে নেই শান্তি। ঘরে নেই নিশ্চিত অন্নসংস্থান। নেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা এ কারণে বলছি, আমাদের র্গামেন্টস্ বা ট্যানারি শিল্প কল-কারাখানাগুলোয় প্রায় সময়ই অগ্নিদগ্ধ হয়ে কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয় অগণিত শ্রমিককে। এদের মৃত্যুর সঠিক কোনও তদন্ত হয় না। এমনকী এদের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষ এদের পরিবারের জন্য তেমন কোন্ও সাহায্য বা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না। এটাই হচ্ছে বর্তমান শ্রমিকদের বাস্তব প্রেক্ষাপট। ক্রেতার স্বার্থ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে গিয়ে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় নেয়ার। আরেক কথায় উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কমানোর। শ্রমজীবীদের এখন আর ভাবা হচ্ছে না একটি বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে। ভাবা হচ্ছে না তারা ঘটাবেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। সমাজতন্ত্র নিয়ে দেখা দিয়েছে অনেক প্রশ্ন! মানুষের অর্থনীতির গোড়ার কথা হলো অভাব মোচন। অভাব মোচন করতে হলে বাড়াতে হবে অর্থনৈতিক দ্রব্যের উৎপাদন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দেশে ক্রমশ বাড়বে বেকারের সংখ্যা। বাড়বে আরও অপরাধপ্রবণতা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটা দেশে মানুষের নিরাপত্তা বাড়ায়। একটা সময় ছিল যখন কৃষিই ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল নিয়ামক। এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিলো প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিক। দেশ এখন কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। তার আঘাত লাগছে গ্রামের কৃষিনির্ভর জীবিকায়। উৎপাদন যদিও বাড়ছে, উৎপাদন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে অনেকে। আমাদের শিল্পের অনেক কাঁচামালও কৃষি থেকে আসে। বাস্তবসম্মত প্রণোদনা না পেলে কৃষক আরও উৎপাদনবিমুখ হয়ে পড়বে, তখন হিমাগারের মতো সংশ্লিষ্ট অনেক শিল্পও পড়বে ঝুঁকিতে। কৃষিখাতে ভর্তুকি, স্বল্প সুদে ঋণ, সহজে সার ও উন্নত বীজ পৌঁছানো, কৃষি উপকরণ কার্ড চালু, বিপণনকেন্দ্র স্থাপনসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষি খাতে সরকার প্রণোদনা জোগাচ্ছে। তবে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় ত্রুটি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে অনেক চাষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। আর পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে ভোক্তাপর্যায়ে ঠিকই মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। এই ভারসাম্যহীনতা কেন আমরা দূর করতে পারি না? শ্রমিকের ঘামে ঘুরছে দেশ-বিদেশের উন্নয়নের চাকা। উন্নতির ধাপে ধাপে শ্রমিকের অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যে শ্রমিকের শ্রমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, সে শ্রমিকের জীবনযাপন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন? তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা উদাসীন। কলে-কারখানায় কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক দুর্ঘটনায় আহত, নিহত হন। রানা প্লাজার মতো গার্মেন্ট দুর্ঘটনার খোঁজ পাওয়া যায় না কত শ্রমিকের!
আমাদের দেশে শ্রমজীবীদের পাশাপাশি সমগ্র জাতীয় অর্থনীতির কথা ভাবতে হবে। কারণ জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি ছাড়া জাতি হিসেবে টিকে থাকা যথেষ্ট কঠিন। সব জাতিকেই তার উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বহু কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আর তা আমাদেরও করতে হবে। মালিক এবং শ্রমিকের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর প্রতিষ্ঠান যা থেকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল ইস্যুকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি ও কল্যাণমুখী সমাধানের পথ খুঁজে বের করা সম্ভব। শ্রমিক তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ‘শ্রমিকের ঘাম সার্থক হোক। তাদের সাফল্যে ও মাহাত্ম্যে উদ্ভাসিত হোক সব মানুষের এই পৃথিবী’।
লেখক : সাংবাদিক