উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো : শ্বেতহস্তী আর কতো দিন!

মাছুম বিল্লাহ |

নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত বিভাগ হিসেবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ওই অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো গঠন করা হয়। যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি তাদের জন্য কাজ, শিক্ষা ও সুযোগ নিশ্চিত করাই এ প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ। তাই এই ব্যুরোর অর্জন ও অভিপ্রায় নিয়ে বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে উঠেছে।

সরকারি হিসেবেই দেশের ২৪ শতাংশ মানুষকে আমরা এখনো সাক্ষর করে তুলতে পারিনি। তার ওপর ফোরজি আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে সাক্ষরতার কী সংজ্ঞা হবে সেটিও ঠিক করা জরুরি। এজন্য উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যুরোর একটি কার্যকর গবেষণা সেল অবশ্যই দরকার ছিলো। যেখান থেকে বর্তমানকালে সাক্ষরতা কী, কতো শতাংশ সেই সাক্ষরতা অর্জন করেছে, কীভাবে সাক্ষরতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা জানতে পারতাম। কিন্তু এই ব্যুরো এসবের ধারে কাছেও নেই। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের সুনশান অফিসে বসে সরকারি প্রটোকল আর গ্রেড নিয়ে চিন্তাই যেনো তাদের বড়ে কাজ। সরেজমিনে গেলে অফিসটির কর্তাদের এসি কক্ষে আরাম করে বসে খোশ গল্পে মেতে থাকতে দেখা যায়। শহরের বসতি বা অবহেলিত জনপদ, হাওর-বাওরের প্রান্তিক এলকা বা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে যাওয়ার কোনো কৌশল কখনো তারা নিতে পারেনি। এখানে সাক্ষরতা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক শিক্ষা, শিশু শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষায়িত কোনো শিক্ষক ও গবেষকও নেই। যারা আছেন তারা সবাই কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাহলে কীভাবে আমরা আশা করবো যে, এই ব্যুারোর মাধ্যমে দেশের সাক্ষরতার হার বাড়বে?

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পুরনো অর্গানোগ্রামে পদের সংখ্যা ৩৭৮। প্রধান কার্যালয়ে বর্তমানে ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তার পদ ১৭টি। ব্যুরোর অধীনে ৬৪টি জেলা কার্যালয় আছে। জেলায় সর্বোচচ পদ সহকারী পরিচালক। সেসব কার্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৯২ জন। এই বিশাল বহরকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পালন করতে প্রতিমাসে নাকি সোয়া কোটি টাকা ব্যয় হয়। এই সোয়া কোটি টাকার আউটপুট কী?

আমরা জানি, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সাধারণত প্রকল্প বা কর্মসূচির মাধ্যমে সাক্ষরতা বাড়ানোর কাজ করে থাকে। এসব প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের কাজ করেন ব্যুরোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সর্বশেষ কর্মসূচি ৬৪ জেলায় মৌলিক সাক্ষরতার প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত থাকা সত্ত্বেও তা এ বছরের জুনে শেষ করে দেয়া হয়। ফলে, এখন তাদের তেমন কোনো কাজ নেই। কেবল দিবস পালন করা ছাড়া। কিন্তু, কেবল এ কাজের জন্য একটি ব্যুরো লালন-পালন করা কতোটা যুক্তিসংগত সেটি নিয়ে চিন্তা করার সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রায় ৪৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে বলে আমরা জেনেছি। 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কাজকে বেগবান করার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির অর্গানোগ্রামের আকার বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়েও ব্যুরোর অফিস খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় একজন কর্মকর্তা, একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও একজন অফিস সহায়কের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপজেলা কর্মকর্তা নিয়োগে সরকারি কর্মকমিশনের কাছে চাহিদার কথা জানানো হয়েছে। সর্বশেষ গত জুনে ২৬৫ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও ৪৪২ জন অফিস সহায়ক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। 

আমরা আরো জানি, মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব অনেকদিন থেকেই। এটি কী কারণে বা কেনো হচ্ছে তার সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বা এতোদিন ব্যুরো যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে তা এর খরচের সঙ্গে মানানসই নয় অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় সে অনুযায়ী আউটপুট নেই। তবে প্রশাসন ক্যাডারের দুই বা তার অধিক কর্মকর্তার পদায়ন ঠিক নিয়মিতই হচ্ছে। তাই বলা চলে, যে উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেই উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে ব্যুরো। 

এই ব্যুরো বাজেট বরাদ্দও দিতে পারে না। এজন্য নির্ভর করতে হয় ডিপিই’র ওপর। সাক্ষরতার হার বাড়ানোর সরাসরি অবদান এই ব্যুরো কতোটা রাখে বা রাখতে পারছে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। এই ব্যুরো সমস্ত কাজই বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে করায়। কারণ এই ব্যুরোর প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে কাজ করার দক্ষতা ও কৌশল, টেকনিক ও অভিজ্ঞতা, উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো কোনোটাই নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে হামবড়া ভাব আর এনজিওগুলোর ওপর খবরদারিই তাদের অন্যতম কাজ। তারা এনজিওর অর্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান আর উপঢৌকন নেন-এমন অভিযোগও আছে।  

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেমন রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী সেই একই ক্যাডারের দুই-তিনজন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতেও রয়েছেন। তারপরেও কেনো উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর বর্তমান রুগ্ন দশা। আগের জেলা পর্যায়ের সহকারী পরিচালকরা বিভিন্ন কর্মসূচি মনিটরিং করতেন। কিন্তু, মাঠ পর্যায়ে এখন কোনো কাজ নেই, সার্ভে নেই। কোনো প্রকল্প নেই। তাই তারা এখন শুধু বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন। 

উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যুরোতে মহাপরিচালক হিসেবে যারা আসেন, কাজের গভীরে ঢুকতে ঢুকতে তাদের হয় রিটায়ারমেন্টের সময় এসে যায়,  না হয় তারা মন্ত্রণালয়ে ফেরত যান। আর ভেতরে যারা আছেন তাদের অধিকাংশের দক্ষতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। এদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ। মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয় তাও অনেকেই জানেন না। কাজেই এই শ্বেতহস্তী পালনের আর কোনো প্রয়োজন আছে কি না রাষ্ট্রকে তা ভাবার উপযুক্ত সময় এসেছে। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ টিম, দৈনিক শিক্ষাডটকম

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026140213012695