উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মৃ*ত্যুবার্ষিকী আজ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে  ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্র ছিলেন তৃতীয়। তার পিতৃদত্ত নাম ছিলো কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় তার পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকট আত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

সুপণ্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে।

তরুণ বয়সেই উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি ঘটে এবং তৎকালীন শিশুকিশোর পত্রিকা সখা, বালক, সাথী, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তার সমগ্র জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, রূপকথা, উপকথা, পৌরাণিক কাহিনী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনাসহ শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। স্বরচিত গ্রন্থে স্বঅঙ্কিত চমকপ্রদ নানা চিত্র সংযোজন উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাশনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত শিশুতোষ মাসিক পত্রিকা সন্দেশ প্রথম প্রকাশিত হয় যা আজও কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্য পত্রিকা।

তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য বহুসংখ্যক সাহিত্য পুস্তক রচনা করেছেন, এর মধ্যে উলে­খযোগ্য গ্রন্থ: ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, সেকালের কথা, মহাভারতের গল্প, ছোট্ট রামায়ণ, টুনটুনির বই এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন। বইগুলোর প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিও তিনি নিজেই অঙ্কন করেন। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতার সঙ্গে সংযোজিত তার অঙ্কন বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। চিত্রাঙ্কনে তিনি সচরাচর পাশ্চাত্য প্রথায় তেলরঙ ও কালিকলম ব্যবহার করতেন। জলরঙের ছবিতেও তিনি কুশলী ছিলেন। ‘বলরামের দেহত্যাগ’ তার অঙ্কিত একটি বিখ্যাত চিত্র।

উপেন্দ্রকিশোর তার প্রথম বই ছোটদের রামায়ণ-এর চিত্রমুদ্রণমানে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিলেত থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে নিজেই একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে স্টুডিও, ডার্করুম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে নানা রঙের হাফটোন মুদ্রণ বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন।

প্রাচ্যে তখন এর কোনো চর্চা ছিলো না, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও তখন এ প্রযুক্তি প্রারম্ভিক পর্যায়ে মাত্র। গণিতে গভীর ব্যুৎপত্তি এবং সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সাহায্যে উপেন্দ্রকিশোর এদেশে বসেই এ বিষয়ে অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। নানা ধরনের ডায়াফ্রাম তৈরি, রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র নির্মাণ, ব্লক নির্মাণের ডায়োটাইপ ও রি-প্রিন্ট পদ্ধতির উদ্ভাবন তার মৌলিক অবদান। পশ্চিমা দেশে তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও মুদ্রণ প্রণালীসমূহ বেশ প্রশংসিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির মাধ্যমেই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণ শিল্প বিকাশের সূত্রপাত ঘটে।

উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে এভাবে নানামুখী যোগ্যতার সমাবেশ ঘটলেও তিনি প্রধানত নির্মল আনন্দরসিক শিশুসাহিত্যিক রূপেই অধিক পরিচিত। এ শিশুসাহিত্য পরবর্তী সময়ে তার পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। কন্যা সুখলতা রাও ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী এবং পুত্র সুকুমার রায় ও সুবিনয় রায় পরবর্তীকালে শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার পৌত্র। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002903938293457