এ কেমন শপথ!

মাছুম বিল্লাহ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

পৃথিবীতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রতি দেশবাসী এমনকি বহির্বিশ্বের মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক, তাদের কাছ থেকে একেবারেই অনুকরণীয় কার্যাবলি দেখতে চায় সবাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী হাল হয়েছিলো তার কারণ আমরা সবাই জানি। কাজেই সে ধরনের কোনো কাজ যাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ না করেন সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তাদের বিশাল অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য বিভিন্ন মহল বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় দেখালাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকের ‘শপথবাক্য’ পাঠ জাতীয় একটি সংবাদ। এটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে, হওয়ারই কথা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী তার ফেসবুকে লিখেছেন, সমন্বয়করা কি স্টুডেন্ট না? সাস্টিয়ান হিসেবে লজ্জিত! কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন ‘স্বপ্নে দেখলাম, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সমন্বয়ক এথেন্সের এক বাজারে বসে সক্রেটিসকে শপথ পড়াচ্ছে’।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে নবনিযুক্ত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সাজেদুল করিম ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময়ের একপর্যায়ে উক্ত উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে শপথবাক্য পাঠ করাতে দেখা যায়। শিক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয়কদের এ ধরনের কাজ করা ঠিক হয়নি বলে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই সমালোচনার মুখে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ পরিবেশ হয়ে পড়ে শোকাবহ।

দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় হতাশা, চলমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাদের উচ্চাশা ও নতুন প্রশাসন আসায় অতিমাত্রায় আপ্লুত হয়ে জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে শাবি তথা দেশের জন্য কাজ করার প্রত্যয়ে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাক্যগুলো সবার মুখে উচ্চারিত হয়েছে। এটি কোনো শপথ অনুষ্ঠান ছিলো না। প্রশাসনের এ ধরনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও মানুষ এখন আর বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ, ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। চুন খেয়ে মুখ নষ্ট করলে দই দেখেও মানুষ ভয় পায়। কারণ, বিগত সরকারের আমলে ছাত্রলীগের নেতারা ভিসি, রেজিস্ট্রার, প্রো-ভিসি নির্বাচন করে মন্ত্রী ও চ্যান্সেলরের কাছে পাঠাতেন শুধু ফরমালিটির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের যতো অপকর্ম তাদের দ্বারা নেতারা করিয়ে নিতেন আর ভিসিরা সেগুলো হজম করতেন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যতো বড় অন্যায়ই করা হোক না কেনো ছাত্রলীগের পক্ষেই প্রশাসনের কর্তারা সাফাই গাইতেন। যখন অবস্থা কিছুটা বেগতিক দেখাতেন, তখন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হতো। কাজেই সত্য হলেও এখন এসব সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ, সবই করানো হয়। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাবি সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব ফেসবুকে লিখেছেন, এটি কোনো আনুষ্ঠানিক শপথ অনুষ্ঠান ছিলো না। নতুন প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় ছিলো। সেখানে শহীদদের আত্মত্যাগ ও জুলাইয়ের স্পিরিট ধরে রাখতে শিক্ষকদের কাছে কয়েকটি দাবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিষয় উঠে আসে। যে ভিডিও সামনে এসেছে, এটি জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞা ছিলো। এ উদ্দেশে আরো সুন্দর ও যথাযথভাবে আমরা উপস্থাপন করতে না পারায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। 

শপথবাক্য পাঠ করানো সহ-সমন্বয়ক পলাশ বখতিয়ার বলেন, নবনিযুক্ত উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ স্যারের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় জুলাই বিপ্লবের কথা স্মরণ করে আমরা অনেকে বক্তব্য দিই। এরই ফলে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধরে রাখতে স্যারদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে অনুরোধ করি। স্যাররা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, তাদের অসম্মান হোক-এটা আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো না। আমরা স্যারদের কাছে অনিচ্ছাকৃত এ ভুলের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবেও আমি স্যারদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এ ধরনের ক্ষমা চাওয়ার জন্য সহসমন্বয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে, তাদের অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে যাতে পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে কোনোভাবেই কোনো কাজ মিলে না যায়। জাতি যে ছবি দেখেছে তাতে সেই ছাত্রলীগ আমলের কথাই সবার স্মরণে আসার কথা, যাদের কথায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উঠতো আর বসতো। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিয়ে সুশিক্ষা আর যুগোপযোগী মানবসম্পদ তৈরি করা যায় না, তৈরি করা যায় জাতীয় সম্পদ লুন্ঠনকারী আর সন্ত্রাসী। আর এতোটি বছর আমরা এ ইতিহাসই প্রত্যক্ষ করেছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সেই ইতিহাসকে উল্টে দেয়ার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, সঙ্গে পেয়েছেন দেশের আপামর জনসাধারণকে। তাদের আত্মত্যাগকে আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন নয়, নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন নয় বরং সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে, যা আগে করা হতো না।  

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
টাকা বানানো ও পাচারের জায়গা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় : অধ্যাপক রোবায়েত - dainik shiksha টাকা বানানো ও পাচারের জায়গা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় : অধ্যাপক রোবায়েত সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে : প্রধান বিচারপতি - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে : প্রধান বিচারপতি ছাত্রলীগ নেত্রীদের গ্রেফতার করিয়ে চালান দেয়ার হুমকি প্রাধ্যক্ষের - dainik shiksha ছাত্রলীগ নেত্রীদের গ্রেফতার করিয়ে চালান দেয়ার হুমকি প্রাধ্যক্ষের প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড পাওয়ার যৌক্তিকতা - dainik shiksha প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড পাওয়ার যৌক্তিকতা ঢাবিতে ক্লাস শুরু রোববার - dainik shiksha ঢাবিতে ক্লাস শুরু রোববার ঢাবিতে তোফাজ্জল হ*ত্যার দায় স্বীকার ৬ শিক্ষার্থীর - dainik shiksha ঢাবিতে তোফাজ্জল হ*ত্যার দায় স্বীকার ৬ শিক্ষার্থীর সাত কলেজ : অধ্যাপক মামুনের প্রস্তাব ও ইডেন কলেজ ছাত্রীর প্রতিক্রিয়া - dainik shiksha সাত কলেজ : অধ্যাপক মামুনের প্রস্তাব ও ইডেন কলেজ ছাত্রীর প্রতিক্রিয়া ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছেন : অ্যাটর্নি জেনারেল - dainik shiksha ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছেন : অ্যাটর্নি জেনারেল ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা - dainik shiksha ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা শিক্ষকদের আতঙ্কের নাম মিনিস্ট্রি অডিট! - dainik shiksha শিক্ষকদের আতঙ্কের নাম মিনিস্ট্রি অডিট! দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033040046691895