এ কেমন শিক্ষার্থী!

মাছুম বিল্লাহ |

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটির একটি কলেজের বিদায়ী শিক্ষার্থীরা ক্লাস রুমের চারটি ফ্যানের পাখা মুচড়ে উল্টো করে রাখেন। ফ্যানগুলোকে তারা নিচ থেকে বাঁকা করে তুলে ব্যবহারের অনুপযোগী করে দেন। শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এর প্রতিবেদনে জানা যায়, ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রাম কুলগাঁও সিটি করপোরেশন কলেজে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের বিদায়ী পরীক্ষার্থীরা এ কাজটি করেন। কলেজের অধ্যক্ষ মনের দুঃখে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের দোয়া করেছেন, তারা যেনো ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হতে পারেন। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে যাতে তারা ভালো মানুষের মতো আচরণ শিখতে পারেন। 

নিজের পোস্টের শেষে তিনি লিখেছেন, এটি ছিলো শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কলেজের উপহার! 

পোস্টটিতে ২৬ হাজার মানুষ রিঅ্যাক্ট করেছেন। দুই হাজার জন কমেন্ট করেছেন। অধ্যক্ষ বলেছেন, মনের ক্ষোভে ও দুঃখে পোস্টটি করেছিলাম যাতে আমার শিক্ষার্থীরা তাদের ভুল বুঝতে পারেন এবং জীবনে সংশোধিত হতে পারেন। 

যারা কমেন্ট করেছেন তারা শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। 

যারা নিজ কলেজের ফ্যানগুলোর অবস্থা ইচ্ছে করেই এভাবে করতে পারেন তারা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে অবদান রাখা তো দূরের কথা, বরং কতোটা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন সেটি মানসচক্ষে যে কেউ আমরা দেখতে পারি। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সহপাঠী, সিনিয়র ও জুনিয়র যারা অনেকেই এখন দেশে, বিদেশে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত তাদের অনেককেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ করতে দেখেছি! আমাদের পুরো সময়টাই ছিলো এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। সময় অসময়, কথায় কথায় হল রেইড এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার। ওই সময় জাতীয় আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ছোট ও বড় সব কারণেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতেন। অনেক আন্দোলনেই আমাদের সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। তখন অবাক হয়ে দেখেছি, অনেক তথাকথিত ভালো ছাত্র এবং এখন অনেকেই অনেক কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন, তারা কীভাবে অযথা গাড়ি ভাঙচুর করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ অযথা নষ্ট করতেন। হলে রুমের পর রুম মহা উৎসাহে সমস্ত জানালা রড দিয়ে ভেঙে ফেলতেন। 

উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে আমাদের সহপাঠী নিজ হাতে হকিস্টিক নিয়ে মারামারি, ভাঙচুর সবকিছুই করেছেন। একদিন আমার রুমমেট (বর্তমানে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন) আমাকে বললেন, এরা এতো বড় বড় কর্মকর্তার ছেলে- অথচ হাতে হকিস্টিক! দেখতে কতোটা বেমানান! তার মানে সমাজে পচন ধরা অনেক আগেই শুরু হয়েছে, এখন তার চরম রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি।  

অধ্যক্ষের হৃদয়টাকে যদি দেখানোর মতো অবস্থা থাকতো এবং আমাদের দেখার চোখ থাকতো তাহলে বোঝা যেতো- কতো অসহায়, কতো দুঃখ, কতো মানসিক যন্ত্রণা এবং কতোটা অভিমান নিয়ে তিনি ফেসবুকের আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি (বরিশাল সরকারি বি এম কলেজ) তখন দেখেছি সমস্ত দেয়াল উল্টাপাল্টা এবং আজেবাজে লেখা দিয়ে ভর্তি। প্রথমদিনই দেখলাম, শুধু মেয়েদের উদ্দেশ্য করে যৌন উত্তেজনার কথা, যৌন বিষয় ও নারীদেহ নিয়ে বহু ধরনের আজেবাজে লেখা। সম্ভবত কলেজ জীবনে প্রথম দিনের উপহার! 

ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবাক করা বিষয়-কলেজে শুধু কবিতা দেখে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম নোংরা ছবিসহ কবিতা, লেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল, বাথরুম সর্বত্র। কী রুচি! 
এই আমরাই কিন্তু স্কুল জীবনে দেখেছি, আমাদের বড় ভাইয়েরা চাঁদা তুলে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য একেক বছর একেক ব্যাচ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দিয়ে যেতেন, আমরাও তাই করেছি। কিন্তু কলেজে উঠে যেনো বেয়াদবি এবং মনুষত্ব আস্তে আস্তে হারানোর দীক্ষা শুরু হয়। উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে এসে সেটি পূর্ণতা পায়। 

কিন্তু মানুষ তৈরির জন্যই তো এসব প্রতিষ্ঠান আমরা তৈরি করছি? শুধু শিক্ষক বা একজন অধ্যক্ষ এতোবড় কাজটি এককভাবে করতে পারবেন না, পারেন না। সবার সহযোগিতা দরকার। ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা। সমাজের যে অধপতন শুরু হয়েছে এবং ইতোমধ্যে অনেক গভীরে চলে গেছে। এর ফল সবাই কমবেশি ভুগতে শুরু করেছি। এক সময় সমাজে ভালো কাজের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, শুধুই পশুত্ব বিরাজ করবে। কাজেই সবাইকে এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। 

ইদানিং পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, ফেসবুক খুললেই দেখা যায়- অমুক স্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যাপক কিংবা অধ্যক্ষকে এলাকার কোনো এক পাতি নেতা কিংবা মাস্তান শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছেন, এমনকি নারী শিক্ষকদেরকেও হেনস্তা করেছেন সবার সামনে। কারণ, ওই শিক্ষক হয়তো তার অভদ্র কোনো ছেলেকে কোনো উপদেশ দিয়েছেন কিংবা একটু বকাঝকা করেছেন। আর তাই তার বা তাদের এই পরিণতি।  

যেসব শিক্ষার্থী কলেজের ফ্যান নষ্ট করে ফেলেছেন অর্থাৎ তাদের নিজ কলেজের সম্পদ নষ্ট করেছেন তারা যে কোনো সময় যেকোনো কিছু নষ্ট করতে পারেন। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, তাদের মানবিকতা, দেশপ্রেম, মমত্ববোধ ও সততা শিখতে হবে। শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমাজ, রাষ্ট্র এবং তার চারপাশের মানুষের জন্য। 

আমরা প্রায়ই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখি পাবলিক পরিবহনে বাস কন্ডাকটরদের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করতে। সামান্য কারণে তারা এসব ঘটান। পরিবহনগুলোকে ঘন ঘন সামান্য কারণে কিংবা কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ ছাড়াই আক্রমণ করেন। হেলপার, কন্ডাকটরদের মারধোর করে গাড়িগুলোকে ভেঙে ফেলেন। তারা যে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তা বোঝানোর জন্য শক্তি প্রদর্শন করেন। বাসের সঙ্গে মারামারি করে এসে অধ্যক্ষ কিংবা ভিসিদের আক্রমণ করেন। তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য, কথা বলার জন্য সহিংস পথে আন্দোলন শুরু করেন। এ যেনো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিরচেনা চিত্র। এ চিত্রকে পাল্টাতে হবে, তা না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যকারিতা পুরোটাই হারিয়ে ফেলবে এবং সমাজ আরো গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এ দায়িত্বটুকু আমাদের সবাইকে পালন করতে হবে।

এই লেখাটি যে ফেসবুক পোস্ট দিয়ে শুরু হয়েছে, তার লেখক অধ্যক্ষ মহোদয় দোয়া করেছেন, আশীর্বাদ করেছেন যেনো তারা (ছাত্ররা) জীবনে ভালো হয়ে যান। ভালো না হলে এ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে থেকে তারা দেশের কতোটা ক্ষতি করবেন সেটি সহজেই অনুমেয়।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, দৈনিক শিক্ষাডটকম 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026888847351074