বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আমরা জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে দেখলাম। তাদের এই অভিজ্ঞতা, কার্যাবলি ও আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইন ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে প্রচণ্ড নেতিবাচক ও ভয়ংকর সব ধারণা পাবার সুযোগ করে দিলো। মানবসম্পদ নির্মাণের অন্যতম কৌশল হলো শিক্ষা। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত হয় শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাকৌশল। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সহজ করে সততা, নিষ্ঠা, আত্মসচেতনতা ও সাহসিকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতেই মানুষ শিক্ষার শক্তিতে বলীয়ান হয়। সাম্প্রতিক অতীতে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। নদীর গতিপথ রোধ করার জন্য বাঁধ দেয়া হলে সে আপনা থেকে তার বিকল্প খুঁজে নেয়; যেমনটি ঘটেছে আমাদের শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলনে। শিক্ষার্থারা কারফিউ ভেঙে রাস্তায় এলেন। সারা দেশের মানুষের সমর্থন আর মমতায় সিক্ত হয়ে তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য সংঘবদ্ধ হলেন এবং ঠিকই তারা বিজয়ী হলেন। গত ৫ আগস্ট দেশের এবং বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আবারো প্রমাণ করল তারুণ্যের শক্তির, রচিত হলো নতুন ইতিহাস।
এজন্য শিক্ষার্থীদের আশঙ্কাজনক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, ফেস করতে হয়েছে নির্বিচার আঘাত, গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট আর শারীরিক নির্যাতন, জখমসহ ও অঙ্গহানির মতো ঘটনা। অনেক শিক্ষার্থীর হাত-পা, আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে। কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেটের আঘাতে বহু শিক্ষার্থীর চোখ নষ্ট হয়েছে, কেউ কেউ আংশিক দৃষ্টি হারিয়েছেন কেউবা দৃষ্টি হারিয়েছেন সারাজীবনের জন্য। আর ট্রমার বিষয়টি তো আছেই। অস্থির আর অনিশ্চিত সময় শেষ হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আবার ক্লাসরুমে তাদের শিক্ষার্থীদের দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। তারা অপেক্ষায় ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক মধুর সম্পর্কের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার।
প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়েছে কিন্তু শিক্ষক শিক্ষার্থীরা আর যেনো সেই আগের সম্পর্কে নেই! দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ আসছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়ও দেখা যাচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদান আর সামগ্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী যেনো একটা ঘটেছে।
আর এসব ঘটনাগুলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফল এবং অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখছি শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের, প্রধান শিক্ষকদের, অধ্যক্ষদের অবরুদ্ধ করে রাখছেন। সামান্য কারণে এমনকি অকারণে শিক্ষকদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করছেন, গায়ে হাত পর্যন্ত দিচ্ছেন। পদত্যাগ করার সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছেন। এ ঘটনাগুলো সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘটছে। এটি এক ধরনের অশুভ ইঙ্গিত। কারণ, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক পবিত্র, জ্ঞানগর্ভ এবং অন্য যেকোনো সম্পর্কের চেয়ে আলাদা যা ভাষায় ব্যাখ্য করা যায় না। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা সবাই নন, কেউ কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, কেউ বা পূর্ববর্তী সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী অনেক কিছু করেছেন হয়তো নিজের ইচ্ছায় নয়, চাকরির খাতিরে কিংবা স্থানীয় দলবাজ কমিটির চাপে। সেই বিষয়গুলোকে সাধারণীকরণ করা কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়। আর এ বিষয়টি প্রশাসনকে দেখলেই ভালো হয়। কারণ, স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ অপসারণের ও বিচার করার কাজে নিয়োজিত হওয়া খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনেকটা ঠিক আছে। কারণ, শিক্ষার্থীরা পরিপক্ক আর অধিকাংশ ভিসিরা ছিলেন সরকারের তল্পিবাহক। ইতিহাস সৃষ্টি করা শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের পরে যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে চির ধরে কিংবা এই পবিত্র সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় নেয় তাহলে সেটি হবে জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দালনের নেতারা, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের অভিভাবকদের বিষয়টিকে শিগগির অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পবিত্র সম্পর্কে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ইতিমধ্যে তার ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, শিক্ষক পদত্যাগের নামে সারা দেশে যা হচ্ছে যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। কেউ যদি ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্য শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় করে তাহলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনের মধ্য দিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিচার হোক। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া, মব জাস্টিস করা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়।’ তিনি আরো বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক আমাদের শিক্ষার পরিবেশকে সুন্দর করে তুলতে পারে সেই সম্পর্ক যেনো তিক্ততার না হয়, দূরত্বের না হয়, ভীতির না হয়। কোন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করতে পারেন না। অনেক শিক্ষার্থী হয়তো জানেই না যে, তাদের ব্যবহার করে অন্য শিক্ষক এ কাজটি করাচ্ছেন ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’
সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনসাধারন ইতিমধ্যে বিষয়টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। তাই আমরা একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা দেখলাম। ঠাকুরগাঁওয়ে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারজন শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করান একদল শিক্ষার্থী। ঘটনার চার দিনের মাথায় ফের সেই চার শিক্ষককে ফিরিয়ে এনে তাদের চেয়ারে বসিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় ফুলের মালা দিয়ে তাদের বরণ করে নেয়া হয়। শিক্ষকদের পা ধরে ক্ষমাও চান শিক্ষার্থীরা।এ সময় শিক্ষকেরাও আবেগাপ্লুত হয়ে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে ধরেন, কোলাকোলি করেন। শিক্ষকদের ফিরিয়ে আনা ও সম্মান দেখানোয় ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে এখন। জানা যায়, চখমিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে গত ২৫ আগস্ট দুপুরে প্রধান শিক্ষকসহ চারজন শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
তারা বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হয়ে প্রিয় শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন, শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে বরণ করে নিয়ে ফের তাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের প্রাইভেট কারে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন এবং ফুলের মালা দিয়ে তাদের বরণ করে নেন। শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষকদের পা ধরে ক্ষমা চান তখন কান্নার রোল পড়ে যায় সেই বিদ্যালয় মাঠে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে। কারণ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক সাধারণ ব্যাখ্যার বাইরে, আমরা চাচ্ছি শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সেই সম্পর্কই সৃষ্টি করে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এক একটি আদর্শ সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে।
লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক