এইচএসসির ফল: দুর্বলদের পোয়াবারো

মাছুম বিল্লাহ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

এবারকার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশে নেই কোনো উত্তাপ, নেই কোনো আনন্দ কিংবা কিছু অর্জনের সাফল্যগাঁথা আর উত্তেজনা। আমরা জানি, এসএসসি ও এইচএসসির পড়াশুনা এবং ফলাফলের মধ্যে সাধারণত বড় একটি গ্যাপ থাকে। যারা এসএসসিতে ভাল ফল লাভ করেন তারা সবাই এইচএসসিতে সেভাবে করেন না। অথচ এবার সেই এসএসসির ফলের উপরই এইচএসসির ফল তৈরি করতে হয়েছে। অতএব, কোনো কিছু প্রাপ্তির যে আনন্দ সেটি থেকে শিক্ষার্থীরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন তেমনি প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক এবং সর্বোপরি দেশ ফল লাভের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো। 

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ উপলক্ষে এবার কোন কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান হয়নি। নিজ নিজ বোর্ড অফিস থেকে ফল প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রতিবছরের মতো এবারও এসএমএস, ওয়েবসাইট ও নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ফল জেনেছেন। সরকার প্রধান বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা কিংবা শিক্ষা উপদেষ্টা ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ছিলেন না। আগের আনুষ্ঠানিকতা এবার দেখা যায়নি। তবে, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সববোর্ড একই সময়ে অর্থাৎ সকাল এগারটায় ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ করেছে। একই সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ফল পেয়ে গেছে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ফল টানিয়ে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। শিক্ষাবোর্ডগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের, বিশেষ করে প্রশাসনিক ও একাডেমকি বিষয়ে উন্নয়নের জন্য বোর্ডগুলো বোধ করি কোনো ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। এমনকি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার সময়ও দেখা যায়, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব সবার উপস্থিতিতে ফল প্রকাশ করা হয়, যেখানে বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের কোনো ভূমিকার উল্লেখ  থাকে না বা দেখা যায় না,  তারা সর্বদাই তটস্থ থাকেন। দুই যুগের সেই ট্রাডিশন থেকে এবার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে, এটিকে সাধুবাদ জানাই।

আমরা জানি, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসএসসি বা সমমান পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে, যা ‘বিষয় ম্যাপিং’ নামে পরিচিত, তার ভিত্তিতে মাঝপথে বাতিল হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল তৈরি করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় একজন পরীক্ষার্থী এসএসসিতে একটি বিষয়ে যত নম্বর পেয়েছিলেন, এইচএসসিতে সেই বিষয় থাকলে তাতে এসএসসির প্রাপ্ত পুরো নম্বর বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আর এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমান পরীক্ষার বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বিষয় ম্যাপিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী নম্বর বিবেচনা করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা বাকি ছিলো। এছাড়া ব্যবহারিক পরীক্ষাও বাকি। এক পর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেয়া হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবির মুখে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার। 

আমাদের স্মরণে আছে, এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের দাবি নিয়ে শত শত পরীক্ষার্থী নজিরবিহীনভাবে গত ২০ আগস্ট  দুপুরে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে ঢুকে পড়েন। পরে তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে (বিষয় ম্যাপিং) হবে মাঝপথে বাতিল করা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল।

এবার এইচএসসি ও সমমানের সকল বোর্ডের পাসের গড় হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ যা গতবছর ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ অর্থাৎ ফল প্রায় একই। নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসিতে এবার পাসের হার ৭৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ যা গতবার ছিল ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ। সারারণ বোর্ডগুলোতে গতবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৫২১ জন শিক্ষার্থী। এবার পেয়েছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন। 

আমরা দেখেছি, ফল প্রকাশের আগের দিনও কতিপয় শিক্ষার্থী শিক্ষাবোর্ডে গিয়ে সবাইকে পাস করিয়ে দেয়ার দাবি তুলেছেন। তরুণ এসব শিক্ষার্থীর আবেগের কাছে বার বার মাথা নত করা যাবে না। কারণ সমাজ, বাস্তবতা, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষায় বার বার এভাবে ছাড় দেয়া মোটেই ঠিক নয়। শিক্ষার মানের সাথে কোন আপস নয়, আর তাই এখন থেকে  কঠোর হতে হবে এবং এক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সব জায়গাতেই মেকি, সব জায়গাতেই অনুপযুক্ত লোক, সর্বত্রই ভূয়াদের দাপট থাকলে সমাজ টিকবে না। পরিশ্রম করে যা অর্জন করা হয়, তাই ঠিক। পরিশ্রমের জন্য কেউ কষ্ট করতে চায় না, পড়াশুনা না করেই সবকিছু পেতে  চায়। এখানে সমাজের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। 

আমরা জানি, সাত বিষয়ের নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হলেও ১৩ বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ ১৩ বিষয়ে অটোপাস দেয়া হয়েছে। তার পরেও লাখো শিক্ষার্থীর নাম অকৃতকার্যের খাতায়। কারণ ৯টি সাধারণ বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে এবার অনুপস্থিত ছিলেন ৯৬ হাজার ৯৯৭ জন পরীক্ষার্থী। আর বহিষ্কার হন ২৯৭ জন। নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকলে কিংবা বহিষ্কার হলে সামগ্রিক ফলাফল অকৃতকার্য আসে। পরীক্ষার মাধ্যমে যে সাতটি বিষয়ের ফলাফল তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কতজন ফেল করেছেন, সেটা জানা প্রয়োজন। সচিবালয়ে একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মধ্যে কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষাণা দিতে হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষাগুলো নিতে পারলে ভাল হতো। এসএসসিতে যারা কোনো বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হবার কারণে পরবর্তী বছরে আবার পরীক্ষার সুযোগ নিয়েছেন সে ফলাফলও নেয়া হয়েছে। কাজেই চূড়ান্ত ফলাফলে যারা উত্তীর্ণ হবেন না, তারা বঞ্চিত হয়েছে বলার সুযোগ নেই। 

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উচচশিক্ষায় প্রবেশ করেন। প্রকৌশল, মেডিকেল, কৃষিসহ সাধারণ শিক্ষায় প্রবেশ করেন। এই দুই স্তরে দুর্বল থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় সমস্যা হওয়ার পরে গোটা শিক্ষা জীবনে তার ছাপ পড়ে এবং পিছিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক দৌঁড়ে। পেশাগত জীবনে যখন প্রবেশ করে তখনও আমরা দেখতে পাই তাদের দুর্বলতার চিত্র। যে কাজে যান তাদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক পেশায় প্রকৃত পেশাদারিত্বের ছাপ রাখতে পারেন,  অধিকাংশ সময়ই তারা ভুল, দুর্বল ও অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। সেজন্য জাতিকে অনেক ভুগতে হয়। সেখান থেকে উপরে ওঠার জন্য অবৈধ সিঁড়ি ব্যবহার করেন। পেশিশক্তি, রাজনীতির দুষ্ট শক্তি ও চক্র ব্যবহার করেন যা পেশাদারিত্ব থেকে বহু দূরে। সারাজীবন চলতে থাকে এর ফল। এখন উচচশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজে না আসে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পড়া, পরীক্ষা না দিয়ে ফলের প্রকৃত চিত্র প্রদর্শনের জন্য উচচতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি ভর্তি পরীক্ষাটা ঠিকভাবে নেয় তাহলে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারবে তাদের ভুল। জাতি বুঝতে পারবে যে, এ ধরনের সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের এবং পড়াশুনা না করে অটোপাসে যে কতো বড় ক্ষতি হয় সেটি। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতেই হবে, শিক্ষাকে তো এভাবে চলতে দেয়া যায় না। 

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি - dainik shiksha ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা ঢাবিতে ভর্তি আবেদনের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha ঢাবিতে ভর্তি আবেদনের সময় বৃদ্ধি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু - dainik shiksha ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উচ্চতর স্কেল পাচ্ছেন ২ হাজার ৯২৩ শিক্ষক - dainik shiksha উচ্চতর স্কেল পাচ্ছেন ২ হাজার ৯২৩ শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026791095733643