হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খানকে ইন্ট্যান্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলো। ওই দায়িত্বের জের ধরে আট মাস পরে হাইকোর্টেরই আরেক বেঞ্চ তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে যদিও উচ্চ আদালতই সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে। কিন্তু, নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় চরম অপমানিত বোধ করেন সাবেক এই শিক্ষাসচিব। এসব নিয়ে তিনি কথা বলেন দৈনিক শিক্ষাডটকম সম্পাদক ও দৈনিক আমাদের বার্তার নির্বাহী সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান খান এর সঙ্গে। পাঠকদের জন্য তার সেই বক্তব্য হুবহু প্রকাশ করা হলো।
একদিন আমি আমার বাসার নিচে একটা চিঠি পেলাম। নিচ থেকে বললো, হাইকোর্ট থেকে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই, যেহেতু পাঁচ বছর হলো রিটায়ার্ড করেছি, মনে একটা প্রশ্ন হলো- কি ব্যাপার, কোনো মামলা-মোকদ্দমায় জড়ালাম কি না!
তো, চিঠিতে হাইকোর্টের একটা অর্ডার আছে। তাতে বলা হয়েছে, আপনাকে (আমাকে) হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চ থেকে একজন জাস্টিস ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছেন। এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ও চেয়ারম্যান।
এটা সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা ছিলো না। আমি কখনোই কোনো ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানে কাজ করিনি। সেজন্য আমি ভেবেছি যে, এটা করবো না, যেহেতু আমার এক্সপারটাইজ নাই।
আমি মাস তিনেক দেরি করেছি। তারপরও ভাবলাম, এটা তো মহামান্য কোর্টের নির্দেশ। হয় মান্য করতে হবে, নইলে মাফ চাইতে হবে। তো আমি চেষ্টা করেছি মাফ চাওয়ার জন্য যে, এটা আমি পারবো না। তো, আমাকে বলছেন (হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারক)- দেখেন, অনেক আগে যখন আমি ছাত্র ছিলাম, ব্যারিস্টারি পড়তে গেছি, তখন আপনাকে দেখেছি। আপনার কথাও শুনেছি। আমার মনে হয়, আপনি পারবেন। এখানে বহু মানুষের, হাজার হাজার মানুষের টাকা তছরুপ করা হয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে। যদি আপনি চেষ্টা করেন, আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেবো। আদালতে ন্যায় বিচারের জন্য যেটা করা দরকার। মানুষ যদি কিছু টাকা ফেরত পায় তাহলেও একটা কাজ হয়। আমরা দেখেছি, এর আগে অনেক প্রতিষ্ঠান, সেখানে মানুষ কোনো টাকা পায়নি। একেবারে নি:স্ব হয়ে গেছে।
তখন আমি কনভিন্স হয়েছি। আমি সবসময় টিটোয়েন্টি খেলতে পছন্দ করি। টেস্ট ম্যাচ টুকটুক করে খেলা পছন্দ করি না। তখন আমি, আমার শুভাকাংখীকে কথাটা বলেছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো যাচ্ছো, তোমাকে ফাঁসিয়ে না দেয়।
শেষ পর্যন্ত আমি সেখানে জয়েন করেছি। তার কারণ হলো যে, এটা কোনো এক্সিকিউটিভ কাজ না। ফুলটাইম কাজ না। দিক নির্দেশনা দেওয়া। তো, আমি জয়েন করলাম। স্টাডি করলাম। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলাম। আর আমার একটা সুযোগ হয়ে গেলো কোভিড পিরিয়ড। আমি এখানে ফুল পিরিয়ড সময় দিতে পারলাম। টার্মিনিওলজি শেখার চেষ্টা করলাম।
কয়েক মাস কাজ করার পর আমি প্রায় ৬০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছি মানুষের। যদিও এখানে ৪২শ কোটি টাকার বিষয়। কিন্তু, আমি ইতোমধ্যে লক্ষ্য করলাম যে, যাদেরকে চাপ দিয়েছি, যারা টাকা নিয়েছে, ১০০ কোটি নিয়েছে, ৬০ কোটি নিয়েছে, ৪০ কোটি নিয়েছে। এখানে হালদার (পিকে হালদার) তো আছেই, তার সহযোগী আছে, যারা টাকা নিয়েছে, টাকা আর দিতে চাচ্ছে না।
আর একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করলাম, মানুষের যে পারসেপশন, যে জেলে ঢুকায়ে দিলে সবকিছু করবে। কিন্তু এখানে দুই ধরনের বিষয়। একটা হচ্ছে যে, এন্টিকরাপশন এবং অন্যরা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে তাদের জেলে দেবে। সেটা আমি সহযোগিতা করতে পারি। কিন্তু, যারা এখানে টাকা রেখেছে, এক কোটি, দুকোটি, পেনশনের সব টাকা। একশ কোটি আছে, সাতশ কোটি টাকাও আছে কিন্তু, ব্যাংকে। তাদের কি হবে, তারা যদি টাকাটা না ফেরত পায়! তখন আমি, যাদের কাছে টাকাটা রয়েছে, তাদের প্রেসার ক্রিয়েট করি, বিভিন্নভাবে। মামলার প্রস্তুতি নিয়েছি, উকিল নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু, উকিল নোটিস দেওয়ার পরে আমার নামেই মামলাই করলো দুই একটা।
আমি তো এসেছি এই ঘটনার অনেক পরে। কোর্ট থেকে আমাকে নিয়োগ করেছে। আমার তো টাকা পয়সা তশ্রুপ করার কোনো সুযোগ নেই। তো, অনেকগুলো লয়ারকোর্ট, তারা এনকোয়ারি চেয়েছে। এখনও এনকোয়ারি আছে। তারা ভেবেছে, তখন তো আমি ছিলাম না।
এর পরে আমি চেষ্টা করেছি, কোর্টের সাথে সহায়তার ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে, যিনি হালদার (পিকে হালদার), তিনি একটা চিঠি দিয়েছেন যে দেশে আসবেন। আমার যে এমডি, তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে। তখন আমি পরামর্শ দিয়েছি, আমরা ডিরেক্ট কোনো মন্তব্য না করে এটা কোর্টে প্লেস করে দিয়েছি। কোর্ট মন্তব্য করবেন।
কিন্তু আমি একদিন টিভিতে দেখছি যে, দুদকের যিনি লইয়ার। খোরশেদ আলম খান সাহেব। উনি বলছেন, এটা এন আই খানের কাছে কেনো লিখেছে সেটা দেখা দরকার। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। তখন আমার একটা কথা মনে পড়লো, এই লইয়ার সাহেবের সঙ্গে আমি একটা টক শোতে বসেছিলাম। সেই টক শোতে তিনি তিনবার উচ্চারণ করলেন যে, সবিচরা লেখাপড়া জানে না। লিখতে জানে না। ভুল করে। খুব তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলো। অনেকক্ষণ শোনার পরে আমি ওই টকশোর ভেতরেই বললাম- এটা থাকতে পারে, কেউ কেউ হয়তো আছে। কিন্তু, বটতলার উকিল ও তো আছে। এ কথা শুনে তিনি বললেন, আপনি একটা প্রফেশনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আমি বললাম, আপনার মনে ছিলো না, এটা আপনি যখন বলছিলেন?
কিছু দিন পরে আরও একটা টক শোতে ডেকেছে। যেখানে বলেছে যে, সরকারি কর্মচারিদের নামে কোনো অভিযোগ এলেই স্ট্যান্ড ডিশমিশ করে দেওয়া উচিত। আমি বলেছি, আমাদের আর্টিকেল ৩৫ এ আছে কাউকে কোনো কারণ না দর্শিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
এরপরে হঠাৎ টেলিভিশনে শুনলাম- আমি বাইরে ছিলাম। আমাকে ফোন করলো। হাজার হাজার ফোন। অনেক রকম মন্তব্য আসলো। ফেসবুকেও অনেক কিছু আসলো। আমি প্রথমে মনে করেছি, কোথাও ভুল করেছে বোধ হয়, আমি নই। দুএকজন আমাকে ফোন করেছে। আমি তাদের বকা দিয়েছি, রাখেন তো এ সমস্ত কি বলেন!
অনেকগুলো টেলিভিশন এভাবে দেখিয়েছে, প্রথমে হালদার, তার পাশে আমার একটা ছবি দিয়েছে। পরদিন দেখি, ইত্তেফাকে লিখেছে, সাবেক চেয়ারম্যান। তো, সাবেক চেয়ারম্যান মানে, যখন টাকা-পয়সা তশ্রুপ হয়েছে তখন আমি ছিলাম, এটা বোঝায়।
যদিও অনেকে অনেক রকম কথা বলেছে, আমি আর বিচলিত হইনি। যদিও আমি একটা পলিটিক্যাল পার্টির মানুষদের সঙ্গে কাজ করেছি, এটাও একটা মওকা হয়তোবা। যে যা পারে, আমাকে কি পরিমাণ লাঞ্ছনা দিয়েছে, সেটা বলে লাভ নেই।
তো আমি একটা প্রেস রিলিজ দিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ভুল করেছে, ভুল করিয়েছে। কিভাবে আসলো এটা? তারপর দেখলাম যে, শেখ কামাল নামে একজন দরখাস্ত করেছে, তার ভেতর আমার নাম লেখা আছে কি না, নাই। আগে পেছনে কিছু লেখা নাই। কিন্তু, যখন একটা অর্ডার দিয়েছে, তখন আমার নামের সঙ্গে লিখে দেওয়া হয়েছে যে, সাবেক শিক্ষাসচিব। তো, ভেরিফাই করা হয়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। যাতে আমি এখান থেকে কেটে পড়ি। আর টাকা পয়সা না দিতে হয়। আমার মনে হয়েছে, তাই। শুধু হালদার না, আরও অনেকেই আছে পেছনে। তারা ভেবেছে, লোকটা তো সুবিধার না। ভেতরে হাত দিচ্ছে। এরকম করে অপমান করলে আমি চলে যাবো। আমি আসলে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিছু দিন আগে বলেছিলাম যে, আমি আর পারছি না।
আমাকে সবাই পরামর্শ দিলো, মামলা করতে হবে। আবেদন করতে হবে। আমি বলেছি, আমার প্রেস রিলিজ দেখেছেন নিশ্চয়ই। আমি সেখানে স্পষ্ট বলেছি, যারা ভুল করেছে তারাই সংশোধন করবে। আমি কেনো আবেদন করবো? আমি কোনো আবেদন করিনি।
কিছু সংস্থার, উপরের কিছু লোকের সাথে তাদের আসলে যোগাযোগ থাকে, আমার যা মনে হয়। এতে একটা ধুম্রজাল হবে। আর কারো নাম দিতে পারবো না। এই ফাঁকে চলে যাবে।
যা হোক. অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে দিয়েছে, আমি শুনেছি। ভবিষ্যতে আইনি প্রক্রিয়া যেটা আছে, সেটা দেখা যাক, কি করা যায়। এতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে সম্মানের। আমি যে মারা যাইনি এটাই বেশি। আমি ভেবেছি, বঙ্গবন্ধু একটা কথা বলেছেন, প্রাথমিকভাবে মনে হয় যে, অন্যায়কারী, তারা জিতে গেলো। তারাই সর্বেসর্বা। কিন্তু এন্ড অব দ্য ডে, সব শেষে দেখা যাবে যে, তাদের একটা বিচার হয়েছে। তারা ভুল বুঝেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, তাদের অন্যায়। তারা শাস্তি পেয়েছে। আমি আশা করবো, আদালতকে যারা ভুল বুঝিয়ে এ কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।