এক বিদ্যালয়ে দুই প্রধান শিক্ষক

রংপুর প্রতিনিধি |

দায়িত্ব পালনের ১৪ বছর পার হলেও প্রধান শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা পাননি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ফুলচৌকি খামারপাড়া রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম। বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাকে দায়িত্বভার দিলেও উপজেলা শিক্ষা অফিসের কারসাজিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে পারেননি তিনি।  

এর উপর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্বে মিজানুর রহমান নামে এক শিক্ষককে পদায়ন করায় জটিলতা আরও বেড়েছে। দুই শিক্ষকই প্রধান শিক্ষক হিসেবে আলাদা রেজিস্টারে স্বাক্ষর করছেন। এ ঘটনাটি উপজেলায় টক অব দ্যা টাউনে পরিণত হয়েছে।

উপজেলা শিক্ষা অফিস ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মিঠাপুকুর উপজেলার শুকুরেরহাট এলাকায় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের স্থানীয় মজিবর রহমান একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ৩৩ শতক জমি দান করেন। সেখানে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ফুলচৌকি খামারপাড়া রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবুল হোসেন, সহকারী শিক্ষক হিসেবে লোকমান হাকিম, আমিনুর রহমান ও ছালেহা খাতুনকে নিয়োগ দেয়। 

এর মধ্যে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়টি মঞ্জুরীপ্রাপ্ত হয়। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে বিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষকের মধ্যে লোকমান হাকিম ও ছালেহা খাতুন সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হন। অপর দুজন শিক্ষকের মধ্যে বিদ্যালয়ে যোগদানকালে প্রধান শিক্ষক আবুল হাসানের বয়স ১৬ বছর এক মাস ও আমিনুর রহমানের ১৫ বছর ২ মাস বয়স হওয়ায় এমপিওভূক্তির যোগ্যতা হারান। 

এরই মধ্যে আবুল হাসান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে ফুলচৌকি খামারপাড়া রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে গেজেটভুক্ত হন। কিন্তু ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মে রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অডিট প্রতিবেদনে আবুল হাসানের বিরুদ্ধে স্ট্যাফিং প্যাটার্ন ও বিধি বহির্ভূত, কম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠান পরিত্যাগকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আবুল হাসানকে তৎকালীন বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি সাময়িক বরখাস্ত করেন। ওই শূন্য পদে বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক লোকমান হাকিমকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। 

ওই বছর ২৬ এপ্রিল ম্যানেজিং কমিটি লোকমান হাকিমকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি প্রদানের বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে অবহিত করেন এবং বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম তার দ্বারা সম্পাদনের অনুরোধ জানান। সেই সঙ্গে তাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে গেজেটভুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। 

প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের লোকমান হাকিমকে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। 

এছাড়া প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন কর্মশালা, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন, ভোটার রেজিস্ট্রেশনসহ সরকারি নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন লোকমান হাকিম। বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামকে সভাপতি, প্রধান শিক্ষক হিসেবে লোকমান হাকিমকে সদস্য সচিব এবং জমিদাতা মজিবর রহমান ও শুকুরেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহফুজুল হককে সদস্য করা হয়। 

এরপর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে উপজেলা শিক্ষা অফিসকে ম্যানেজ করে বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান ফুলচৌকি খামারপাড়া রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বপদে ফিরে আসেন। তবে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষা অফিস লোকমান হোসেনকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে না দিয়ে সেই দায়িত্বে বহাল রাখেন। আবুল হাসান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই মনগড়া ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেন বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছিলেন। এতে বিদ্যালয়ের জমিদাতা মজিবর রহমানকে বাদ দিয়ে ভুয়া দাতা সদস্য মিজানুর রহমানকে কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত করেন। 

বিষয়টি জানতে পেরে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর দাতা সদস্য মজিবর রহমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানান। অবস্থা বেগতিক দেখে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ফ্রেব্রুয়ারি ফুলচৌকি খামারপাড়া রেজিঃ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বদলি হয়ে উপজেলার মোসলেম বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন আবুল হাসান। লোকমান হাকিম প্রধান শিক্ষক হিসেবে গেজেটভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষা অফিস ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মিজানুর রহমানকে ফুলচৌকি খামারবাড়ি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করে। এক বিদ্যালয়ে দুই প্রধান শিক্ষক হওয়ায় পাঠদান, ম্যানেজিং কমিটি গঠনসহ নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে।

ফুলচৌকি খামারবাড়ি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম এমপিওভুক্ত শিক্ষক আমি। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হলে যোগ্যতা ও জেষ্ঠ্যতা দেখে ম্যানেজিং কমিটি আমাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করেন। আমি দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে আজ অবধি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। এর মধ্যে আবুল হাসান ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের আবার পদায়ন হয় কিন্তু তখনও আমাকে ম্যানেজিং কমিটি ও উপজেলা শিক্ষা অফিস প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে রেখেছে। আমার নামে সরকারি চিঠিপত্র এখনও আসছে। বর্তমানে আমাকে প্রধান শিক্ষক পদে বহাল রেখে মিজানুর রহমান নামে আরেক শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, জেষ্ঠ্যতা, দক্ষতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষকের পদে আমি হকদার। কিন্তু অদৃশ্য শক্তি আমাকে এ পদে পদায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরী করেছে। আমি বেতন-ভাতাদি না পেয়ে মানবেতর জীবন- যাপন করছি। আমি শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এর সুষ্ঠু সমাধান চাই।

এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আক্তারুল ইসলাম বলেন, লোকমান হাকিম দীর্ঘ দিন ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই স্কুলের জটিলতা নিরসনের বিষয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। তারাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, এখানে আমার করার কিছু নেই।
 
উপজেলা শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সরকার বলেন, প্রধান শিক্ষকের পদটি লোকমান হাকিমের ন্যায্য পাওনা হলে সেটি তার পাওয়া উচিত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0020859241485596