এক শিফটের বিষয় আর ঘোলাটে নয়

মাছুম বিল্লাহ |

দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করতে হলে আরও শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন। বাড়াতে হবে ক্লাসরুমের সংখ্যা। এমন মত শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকের। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও ক্লাসরুমের সংখ্যা না বাড়িয়ে  এক শিফট বাস্তবায়নের নির্দেশনা জারির বিষয়টিকে অনেকেই ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয় বলছে, পাশাপাশি অবস্থিত দুই বা ততোধিক স্কুল সমন্বয় করে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে। আর এতে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে। এরই মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরিদর্শন শুরু করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যাচেছ, কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরো বিষয় ম্যানেজ করতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হচেছ। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা সময়মতো বিদ্যালয়ে আসছেনই না।

মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু প্রতিষ্ঠানে  ৫ থেকে ৭ জন শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী আছেন  ৫ থেক ৬ জন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে ২ থেকে ৩ জন শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী স্যংখা কয়েকশ। কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় ৬৬ হাজার। এর মধ্যে সারাদেশে ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী থাকা স্কুল আছে হাজার খানেক। এগুলোর অধিকাংশতেই শিক্ষার্থী আছেন ১০ থেকে ১২ জন। আর ১০০ জনের কম শিক্ষার্থী আছেন কয়েক হাজার স্কুলে। শিক্ষক সংখ্যায় ভারসাম্যহীনতা, দূরত্ব, শিখন ঘণ্টা বাড়ানো ও শিফট ইত্যাদি বিবেচনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করার  সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এক শিফটের যৌক্তিকতা

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা নিদের্শনায় বলা হয়েছে, যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক রয়েছেন, সেগুলোতে অবিলম্বে এক শিফট চালু করতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক বা শ্রেণিকক্ষ নেই বা উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে সেসব বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচচ এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এমন দুটি বিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে দুই ভাগ করে একক শিফটে পাঠদান পরিচালনা করতে হবে। এই বিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একটি বিদ্যালয়ে এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অন্য বিদ্যালয়ে পাঠদান করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। দেখা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানে তিনটি কক্ষ আছে। পাশের একটি বিদ্যালয়েও হয়তো তিনটি কক্ষ রয়েছে। এ ধরনের স্কুলগুলোর মধ্যে পাঠদান সমন্বয় করা হবে। এতে কোনো শিক্ষক বাদ যাবেন না, বা কোনো স্কুল বিলুপ্ত হবে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কোনো সমস্যা হবে না। 

মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, অনেক স্কুলে বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও সে স্কুলের অবকাঠামোগত সক্ষমতা নেই। আবার পাশের স্কুলেই শিক্ষার্থী কম। এ ধরনের দুটি বিদ্যালয় সমন্বয় হলে বেশি শিক্ষার্থী থাকা প্রতিষ্টানটির জন্য নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন হবে না। ফলে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে। এক শিফট হলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হবার সুযোগ পাবেন। শিক্ষকরা শ্রেণি পাঠদানের সময় বেশি পাবেন। তাই শিখন-শেখানো কার্যক্রম অধিক ফলপ্রসূ হবে। শিক্ষার্থীরা বেশি করে কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। দুই শিফটে সময়ের অভাবে সংগীত চর্চা , কবিতা আবৃত্তি, শ্রুতি লিখন ও দেয়াল পত্রিকা তৈরি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। 

তাছাড়া এক শিফট মানে হচেছ, সব শিক্ষার্থীর একই পরিমাণ সময়। ফলে শিশুরা খেলাধুলা করার সুযোগ পাবেন। কিন্ডারগার্টেন ও হাইস্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সময়সূচিও একই করা উচিত বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। 

যেসব সমস্যার কথা বলা হচেছ

এ নির্দেশ জারির পর বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাস্তবে এ আদেশ প্রতিপালন করা কঠিন। সব বিদ্যালয়ে এক শিফট করতে গেলে আরও শিক্ষক প্রয়োজন। দরকার হবে বাড়তি ক্লাসরুমেরও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুরা পড়েন। রয়েছেন প্রাক-প্রাথমিকের খুদেরাও। তাদের পক্ষে এক কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা বাস্তবসম্মত নয়। 

এ সিদ্ধান্তের কারণে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে ছাত্রীদের পক্ষে দূরের স্কুলে গিয়ে পাঠগ্রহণ সব সময় সম্ভব হবে না। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যাও কমে যেতে পারে। নষ্ট হবে ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যার ভারসাম্য। উপরন্তু চর, হাওর-বাওড় ও পার্বত্য অঞ্চলের মতো দুর্গম এলকায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। দুই পৃথক বিদ্যালয় একীভূত করা হলে যে বিদ্যালয়ে ক্লাস হবে না, সেই বিদ্যালয়ের ভূমি, ভবন, পুকুর অন্যান্য সম্পত্তির রক্ষনাবেক্ষণ কীভাবে হবে-এসব প্রশ্নের উত্তরও মিলছে না।

বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৫৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে এক কোটি ৪২ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছেন। শিক্ষক রয়েছেন চার লাখের বেশি। 

সাড়ে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯০ ভাগই ডাবল শিফটের স্কুল। এ সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। এক শিফটের স্কুলগুলোতে সকাল ৯টায় পাঠদান শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায় শেষ হয়। আর দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শিফট সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা, ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সমাবেশ ও পিটি এবং দ্বিতীয় শিফটে সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত টানা পাঠদান চলে। ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে (শীতকালীন) ডাবল শিফটের স্কুল সকাল সোয়া ৮টা থেকে সোয়া ১১টা, দ্বিতীয় শিফট সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলে। 

গ্রামীন অনেক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ এক শিফট চালানোর মতো উপযুক্ত নয়। পাশাপাশি বিদ্যালয় অবস্থিত হলেও দুটির দূরত্ব কোথাও এক, কোথাও দুই কিংবা তিন কিলোমিটার। এভাবে এক বিদ্যালয় থেকে আরেক বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতে শিক্ষার্থীদের কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কারণে বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য বিকল্প প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা ভাবছেন। তাছাড়া বাচ্চারা তো নতুন পরিবেশে, নতুন জায়গায় খাপ খাওয়াতে পারবেন না। 

রাজধানীর এক প্রধান শিক্ষক বলেন, এক শিফটের ক্লাস চালু করতে হলে ন্যূনতম ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। তবুও তাদের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটানা ক্লাস নিতে হবে। কোন কারণে একজন শিক্ষক ছুটিতে থাকলে সেদিন সব বিষয়ের ক্লাস হবে না। এ অবস্থায় এক শিফট চালু করতে গিয়ে বিদ্যালয় ভাগাভাগি করলে বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে। এক শিফটের স্কুলের সময় দাঁড়ায় সাত ঘণ্টা যা প্রাথমিকের শিশুদের জন্য উপযোগী তো নয়ই, বরং বিরক্তিকর। এক সময় বাচ্চাদের পুষ্টিমানের বিস্কুট দেওয়া হতো যা এখন আর নেই। তাহলে এতো সময় ছোট ছোট শিশুরা না খেয়ে কিভাবে দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে থাকবেন। তারা সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে অতিরিক্ত হলে দু’টার মধ্যে যদি বাসায় আসতে পারেন তাহলে বাসায় খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে পারেন, বিকেলে খেলাধুলা করতে পারেন। 

উপসংহার

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব যেটি বলেছেন তা অত্যন্ত যৌক্তিক। তিনি বলেছেন, সব বিদ্যালয়ে এক শিফট একসঙ্গে হবে না, করাও যাবে না। প্রাথমিকভাবে ১২ হাজার বিদ্যালয় নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গবেষণা আছে এবং এই বার হাজারে এক শিফট করতে সমস্যা নেই। পরের ধাপে আরও কিছু বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করা হবে। কাজটি হবে ধাপে ধাপে। 

তিনি আরও বলেন, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে মাত্র ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী আছেন। কোথাও আধা কিলোমিটারের মধ্যে দুটি স্কুল, কোথাও আবার ২০ গজ, ৫০ গজের মধ্যে দুটি স্কুল রয়েছে। সেখানে এতো সংখ্যক শিক্ষক রাখা যৌক্তিক নয়। কোনো বিদ্যালয়ে নাকি ১৭ জন পর্যন্ত শিক্ষক আছেন। আবার কোথাও তিনজন। তাই এই উদ্যোগ।

সবিচ মহোদয় অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমাদের সঠিক পরিকল্পনার ভুলের খেসারত দিতে হচেছ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। জাতীয়করণ করার সময় বিষয়গুলো সঠিকভাবে বিবেচনায় নিলে শিশুদের কষ্ট হতো না। 

একটি বিদ্যালয়ে ৪/৫ জন শিক্ষার্থী, আর সরকারি শিক্ষক থাকবেন ৫-৬ জন এটি তো কোন যুক্তির কথা নয়। অতএব মাননীয় সচিব যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বিষয়টি এখন আর ঘোলাটে থাকার কথা নয়।  

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট-  ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব)

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032658576965332