একজন মানবিক হারুন ভাই

দুলাল আচার্য |

সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হারুন উর রসিদ। আমাদের তথা সাংবাদিক সমাজের প্রিয় হারুন ভাই। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে গেলো তার চলে যাওয়ার। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিন তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সংবাদটি আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিলো। মহামারি করোনায় একে একে আমরা তখন বহু আপনজন, স্বজনকে হারিয়েছিলাম। হারুন ভাই তাদেরই একজন। সময়টা ছিলো ভয়াবহ। সারাক্ষণ তখন মৃত্যুশঙ্কা কাজ করতো। সেই ভয়াল আতঙ্কের মধ্যেই আমরা হারুন ভাইকে হারাই। 

তিনি আমাদের মাঝে নেই, তা আজও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি ছিলেন একজন বহুগুণে গুণান্বিত মানুষ। সবকিছুর মধ্যে তার অন্যতম গুণ-তিনি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। তাকে দেখতে যতোটা গম্ভীর মনে হতো না কেনো, তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মমুখী হাস্যোজ্জ্বল, মেধাবী একজন মানুষ। ছিলেন সাংবাদিক সমাজের প্রিয়ভাজন। বিনয়ী, সদালাপি ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সবার কাছে ছিলো তার গ্রহণযোগ্যতা।

হারুন ভাই মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নং সেক্টরে যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশের সাতজন যুদ্ধ প্রতিবেদকের মধ্যে একজন। পরে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববতী সময়ে দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সমাজ-এ সাংবাদিকতা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তথ্য অফিসার হিসেবে তথ্য অধিদপ্তরে যোগদান করেন। 

সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ছিলো তার অবিচল আস্থা। কর্মক্ষেত্রেও সে প্রমাণ তিনি রেখেছেন। তার আস্থা, বিশ্বাস আর ভরসার কেন্দ্র ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা শেখ হাসিনা। সব সময় তিনি বলতেন যতো দিন শেখ হাসিনা বেঁচে থাকবেন, ততো দিন বাংলাদেশ নিরাপদ। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা থাকাকালীন তিনি বঙ্গবন্ধুর যাবতীয় দুর্লভ ভাষণ, বক্তব্য-বিবৃতি সিডিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। তার কল্যাণেই হারিয়ে যাওয়া বা উদ্দেশ্যমূলক নষ্ট করা বহু টেপ থেকে সংগৃহীত ভাষণ ও ছবি আমরা এখন পাচ্ছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের সব ডকুমেন্টস ধ্বংসের উদ্যোগ নেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। সেই সময় তথ্য অধিদপ্তরের কর্মরত ছিলেন হারুন ভাই। তিনি সেইসব ডকুমেন্টস গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষণ করেন। জানা যায়, খাবারের বাটির মধ্য দিয়ে তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টস বাসায় নিয়ে আসেন। পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। 

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে তাকে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান তথ্য অফিসার নিযুক্ত করা হয়। পিআইডির দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যাপক পরির্বতন আনেন। তার কালেই পিআইডিতে ডিজিটাইলাইজেশনের ছোঁয়া লাগে। পিআইডিতে ডিজিটাল ফটোল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ তিনিই নিয়েছিলেন।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াত তথা চারদলীয় জোট সরকার বহু মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে নানা অজুহাতে চাকরিচ্যুত করে। এই তালিকায় হারুন ভাইও ছিলেন। প্রথমে তাকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি এ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হয়েই চাকরিচ্যুতির সুযোগ না দিয়ে তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন। জোট সরকার সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করে। অবশ্য এ নিয়ে তার কোনো দুঃখ ছিলো না। অবশ্য ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনা সরকার তাকে দুই বছরের জন্য আবার প্রধান তথ্য কর্মকর্তা পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। এই দুই বছরে তিনি সরকারের কর্মকাণ্ড জনসাধারণের কাছে সফলভাবে তুলে ধরেন।

তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূচনা ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পর। আমি তখন শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার সহসম্পাদক। আমাদের অফিস ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের পাশের বাড়ি (বর্তমানে সংযুক্ত)। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রীর ‘প্রেস উইং’ ছিলিা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বিচিত্রা অফিসে। জাওয়াদুল করিম সাহেব মারা যাওয়ার পর হারুন ভাই সেখানে নিয়মিত আসতেন। সাংবাদিক মহলে তখন বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে তার নামটি বেশ উচ্চারিত হয়। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎই তিনি নিরুদ্দেশ। একজন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে আমার জানার সুযোগ হয়নি তিনি কেনো আর ফিরে আসেননি। কিছুদিন পর প্রেস সেক্রেটারি হন আবুল কালাম আজাদ (বর্তমানে বাসস-এর এমডি)। পরে নানা সময়ে হারুন ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতো। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পিআইও (চুক্তিভিত্তিক) হলেন। একদিন ফোন করলাম। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন দুলাল একদিন অফিসে আসেন, চা খেয়ে যান। আমি বললাম, ভাই আমার তো পাস (অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড) নেই। বললেন আসেন আমি পাস দেবো। একদিন ফোন করে অফিসে গেলাম। সেদিন নানা গল্পের পর আসার সময় একটি ফরম ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘এটি পূরণ করে নিয়ে আসেন, আমি আপনাকে কার্ড (অ্যাক্রেডিটেশন কাড) দেবো। আপনারা তো জেনুইন সাংবাদিক, আপনাদের এটা প্রাপ্য।’ কয়েক দিন পর সম্পাদকের স্বাক্ষর নিয়ে ছবিসহ ফরমটি পূরণ করে নিয়ে গেলাম। ভাবলাম হয়তো কয়েক দিন লাগবে। আমি উঠতে চাইলে বললেন কার্ড নেবেন না? একটু অপেক্ষা করুন, আজই নিয়ে যান। প্রায় ২০ মিনিট পর হাতে একটি কার্ড পেলাম। সেদিন নিজেকে খুব উৎফুল্ল লাগছিলো। এই আনন্দ ভাষায় বর্ণনার অতীত। এই আমাদের হারুন ভাই। মানুষকে সহায়তা করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মনোবৃত্তিই তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সর্বশেষ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ছোট ভাই রাহুলের বউভাতে তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়। একসঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম। আজ হারুন ভাই কেবলই ছবি।    

তাকে সহজভাবে মূল্যায়ন করলে বলতেই হবে সাংবাদিকবান্ধব একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি নীরবে, নিভৃতে কাজ করতে ভালোবাসতেন। যে কাজে ছিলো বিশ্বাস, আদর্শ আর দেশপ্রেমের অনন্যতা। হারুন ভাই নেই কিন্তু তার কর্মময় জীবন আমাদের কাছে প্রেরণা। মৃত্যুবার্ষিকীতে পরম করুণাময়ের কাছে তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক: সাংবাদিক 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026929378509521