একটি ট্রাম্প কার্ড ও রাজনৈতিক সমীকরণ

মাজহার মান্নান |

রাজনীতির মাঠের হিসাব বড় জটিল। কখন কোন পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা আগে থেকে বলা মুশকিল।  কেনোনা রাজনীতি এমন একটি বিষয় যা শুধু নিজের দেশ নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর একটি যোগসূত্র রয়েছে। মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মাঠে আলোচনার শেষ নেই। কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক পক্ষগুলো থেকে ‘খেলা হবে’ এমন একটি শব্দ বারবার উচ্চারিত হচ্ছিলো। জনগণও খেলা দেখার আশায় ছিলো। 

তাস খেলায় ট্রাম্প কার্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিপক্ষকে হারাতে ট্রাম্প কার্ড ব্যবহৃত হয়। সেখানে ওভার ট্রাম্পেরও সুযোগ থাকে। কিন্তু আমেরিকা এমন এক ট্রাম্প কার্ড ব্যবহার করেছে যেটাকে আর ওভার ট্রাম্প করা যাচ্ছে না। এই বেরসিক ট্রাম্প কার্ডটি রাজনৈতিক খেলায় এক জটিল সমীকরণের জন্ম দিয়েছে।

ট্রাম্প কার্ডটির ধরণ এমন যে এটার জালে যে কেউ আটকা পড়তে পারে। অনেকটা ব্ল্যাঙ্ক চেকের মতো। চেক স্বাক্ষর করে দেয়া হয়েছে, এখন শুধু নাম বসানোর বাকি। এটা এক অদ্ভুত ধরণের খেলা। খেলায় আনন্দ থাকে, চাপা উত্তেজনা থাকে,  কিন্তু এ এক বেরসিক খেলা যেটা রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সবাই চায়। বিদেশিরাও চায়। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম তো আর কম হলো না।  ২০২৩-এর শেষে বা ২০২৪-এর জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। উত্তাপটি মূলত একটি বিষয়কেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আর সেটি হলো নির্বাচন কি দলীয় সরকারের অধীনে হবে নাকি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে। এ বিষয়ে বড় দু’টি দলের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অনড়। কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং দেশের আপামর জনগণ একটি গ্রহণযোগ্য সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে অনর্থক সংলাপে কোনো সমাধান আসে না। সংলাপ হতে হবে অর্থবহ। আর অর্থবহ সংলাপের জন্য প্রয়োজন ছাড় দেয়ার মানসিকতা। প্রশ্ন হলো মার্কিন ভিসানীতিটি কি বড় দুই দলকে এক টেবিলে বসাতে পারবে? যদি পারে তবে সত্যি কি সমাধান আসবে। মাঠের ভোটের হিসাবের খোঁজ রাজনৈতিক দলগুলো খুব ভালোভাবেই জানে। কাজেই ভোটের জোয়ার কোনদিকে যেতে পারে সেটা হিসাব করেই বড় দুই দল আগাবে। এক্ষেত্রে ভিসা নীতি কি সমন্বয়কের ভূমিকা নিতে পারবে?  মার্কিন ভিসা নীতি কারো জন্য পৌষ মাস আর কারো জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ, মার্কিন মুলুকের সঙ্গে আমাদের রাজনীতির অনেক হিসাব জড়িত। তবে ভিসা নীতি আমাদের জন্য মোটেও গর্বের কোনো বিষয় নয়। এটা এক ধরনের শাস্তি। সুষ্ঠু ভোটের জন্য এই নীতিটি আপাতত উত্তম মনে হলেও এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী।

আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথটি মোটেও সহজ ছিলো না। বছরের পর বছর আন্দোলন করতে হয়েছে। রক্তপাত হয়েছে। জেল জুলুম আর নির্যাতনের দাবানলে পুড়তে হয়েছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য। আমাদের এই স্বাধীনতার দরকার ছিলো আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র এবং উন্নায়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য। প্রশ্ন হলো স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমরা সেটার কতোটুকু পেয়েছি। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন ও উন্নয়নের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে। একটি দেশের উন্নয়ন মানে সেই দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। গণতন্ত্র একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং পাকিস্তান তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছিলো যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো সুশাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা, আমলাতান্ত্রিক সততা, জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা।

২০১৪ এবং ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে যে নির্বাচন হয়েছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। সেই ধরণের নির্বাচন জাতি আসলে আর চায় না। হাজার উন্নয়ন হলে মানুষ তার নিজের ভোটটি দিতে চায়। নিজের ভোটের অধিকার কেউ হারাতে চায় না।  বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না গেলে কী হবে? আরেকটি একতরফা নির্বাচন কি তবে হয়ে যাবে? এমন পরিস্থিতি এখন নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তা ছাড়া, ট্রাম্প কার্ডের ভয় সবারই কম বেশি আছে। মাকিন ভিসা নীতি নিয়ে বড় দুই দল ভেতরে ভেতরে টেনশনে আছে কিন্তু বাইরে তারা সেটা প্রকাশ করতে চায় না। ভিসা নীতি কার ঘাড়ে চাপবে এ নিয়ে মাথাব্যথার শেষ নেই। নির্বাচন কমিশন বারবার তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানের জানান দিচ্ছে। কমিশন বলছে তাদের একার পক্ষে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া অসম্ভব। নির্বাচনের সময় কমিশনের সহায়ক শক্তিগুলো যদি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীনভাবে কাজ করে তবেই একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব। বিরোধী শিবির মনে করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কমিশন একটি সুষ্ঠ নির্বাচন করতে পারে। বড় দুটি দল অনড় অবস্থানে থাকা মানেই সংঘাত অনিবার্য। তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই আর সেটা হলো সংলাপ। একটি আন্তরিক সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যেখানে সংলাপ সফল হয় না। জনগণের ওপর আস্থা রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। জনগণ যদি ভোট না দেয় এমন আতঙ্ক কাজ করে। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় থাকে তারা। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে এ ধরনের শঙ্কার সুযোগ তৈরি হয় না। জনগণ যাকে ভোট দেবে সে ক্ষমতা নেবে এমন মানসিকতা যদি তৈরি হয় তবে কোনো ঝামেলাই থাকে। নানা কৌশলের পরিবর্তে তখন জনগণের দোরগোড়ায় রাজনীতিকরা যেতে থাকে। সংলাপে বসার আগে ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে বসতে হবে। ২০১৮-এর নির্বাচনের আগে বিএনপি’র সঙ্গে সরকারের সংলাপ হয়েছিলো। বিএনপি নির্বাচনও করে, কিন্তু নির্বাচন ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তত্ত্বাবধায়কে হয়তো ফেরা যাবে না কিন্তু সংলাপের মাধ্যমে নতুন কোনো পথ সহজেই খুঁজে নেয়া যায়। আর নতুন পথ বের করার জন্য যদি সংবিধানে সংশোধনী আনতে হয় সেটা অসম্ভব কিছু না রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার পালাবদলে তাদের অবস্থান কী হতে পারে সেটার হিসাব আগে করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঠিক এমনই। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও একটি স্থিতিশীল নির্বাচনী ব্যবস্থা দাঁড় করানো গেলো না এটা সত্যি দুঃখজনক।

মার্কিন ভিসানীতির ভয়ে নয়, বরং ভিসানীতি চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে একটি ঐক্যমতে পৌঁছানো। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অযৌক্তিক কোন দাবি নয়। পৃথিবীর বহু দেশে দলীয় সরকারের অধীনেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেন সেটা হয় না? এর মূল কারণ হলো প্রতিপক্ষের প্রতি মারমুখী আচরণ। বড় দুটি দলের রাজনৈতিক হিসাব ক্ষমতাকেন্দ্রিক। আর ক্ষমতায় যেতে হলে সুষ্ঠ ভোটের মাধ্যমেই যেতে হবে। ২০১৮ তে যদি সরকার একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারতো তবে আজ নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন কথাই উঠতো না। বিএনপি ২০১৮ তে সরকারের প্রতি আস্থা রেখেছিলো। কিন্তু তাদের সেই আস্থার জায়গাটি নষ্ট হয়ে গেছে। এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। ২০১৮ তে বিএনপি যে হিসাবটি করেছিলো তাতে মনে হয়েছিলো তারা সরকার গঠন করতে না পারলেও একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে তারা সংসদে থাকবে। কিন্তু সব হিসাব উল্টে যায়। মাত্র ৬ টি আসন নিয়ে তাদের সংসদে যেতে হয়। আওয়ামীলীগ বা বিএনপি যে কোন একটি দল সরকার গঠন করবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা মাঠে তাদের প্রচুর ভোট আছে। এ দুই দলের বাইরে আপাতত কোন বিকল্প নেই। আর দু দলের অবস্থান যদি ভয়ংকর মাত্রায় বিরোধী হয় তবে জনগণ সেটার ভুক্তভোগী হবে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা হেয় প্রতিপন্ন হবো।  মার্কিন ভিসানীতি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কতটা চাপ তৈরি করবে সেটা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে হোক, বা জনগণের চাপে হোক একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন সবার কাম্য।  সরকারের উচিত হবে বিরোধী শিবিরকে সংলাপে ডেকে একটি সুন্দর নজীর স্থাপন করা। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি সকল ধরণের নির্বাচন বর্জন করে আসছে। যার কারণে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। এটি গণতন্ত্রের জন্য মোটেও ভাল লক্ষণ নয়। তাই ২০২৪ এর শুরুতে যে নির্বাচন হবে সেটা অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। আর যদি না হয় তবে মার্কিন ট্রাম্প কার্ডের জালে হয়তো অনেকেই আটকা পড়বেন। একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য এদেশের মানুষের রক্ত কম ঝরেনি। আর রক্তারক্তি না হোক এটাই দেশবাসীর একমাত্র চাওয়া।

লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005903959274292