দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক : ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ কয়েকটি জায়গায় একযোগে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চের ঢাকা ছিলো স্তম্ভিত, শোকার্ত ও ভয়াল এক নগরী।
শহরে ছিলো কারফিউ। কিন্তু তার মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন অলিগলি পাড়ি দিয়ে শহর ছাড়তে শুরু করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরী বলেন, সেদিন ঢাকাতেই ছিলেন এমন কয়েকজন জানিয়েছে, শহরের যেকোনো জায়গা থেকেই আগুন আর ধোঁয়া থেকেই রাতের আক্রমণের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছিলো। শহরে কোনো ধরনের পরিবহন ছিলো না, মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো। কারও সাথে দেখা হলেও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক, গবেষক ও ঢাকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, পঁচিশে মার্চের রাতের গণহত্যার জের ধরে ২৬শে মার্চের দিনের বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ও রাজারবাগের পুলিশ লাইনস এলাকায় আগুনের কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিলো।
এর মধ্যেও পরিচিতদের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। যদিও কারফিউ থাকায় বের হওয়ার সুযোগ ছিলো সীমিত।
তেজগাঁও এলাকায় রাইফেল হাতে পুলিশ সদস্যদের সাথে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন এখনকার ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হাসান।
তিনি বলেন, আমরা সেদিন তেজগাঁও এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলাম। ইপিআরের তিন নম্বর গেটেও ভালো প্রতিরোধের খবর পাচ্ছিলাম। পিলখানা ও রাজারবাগে যে প্রতিরোধ রচনা করেছিলো পঁচিশে মার্চের রাতে, তা চলছিলো ছাব্বিশে মার্চের সকাল পর্যন্ত। যদিও শেষ পর্যন্ত আক্রমণের মুখে টিতে পারেনি ইপিআর ও পুলিশ।
এমন পরিস্থিতিতে ছাব্বিশে মার্চের দুপুর থেকেই আসলে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দলে দলে পালাতে শুরু করে। দু'একটি এলাকায় টেলিফোন সচল থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় তাও ছিলো না। দুপুরের পর থেকে অনেকে পরিচিত বা স্বজনদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের এলাকায় যাদের স্বজনরা ছিলো, নানাভাবে তাদের খোঁজে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।
মি. হাসান পরদিন সাতাশে মার্চে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময়গুহ ঠাকুরতাসহ অনেককে। পরে তিনি জগন্নাথ হল এলাকা থেকেও এক নিকটাত্মীয়কে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
তিনি বলেন, পুরো এলাকা ছিলো ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা। যেখানে সেখানে পড়ে ছিলো মৃতদেহ।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলো বইতে ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চের বর্ণনা লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন, “... অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। যা তাণ্ডব হচ্ছে চারদিকে, কারফিউ না দিলেও বাইরে বের হয় কার সাধ্যি! গোলাগুলির শব্দ থামেই না। মাঝে মাঝে কমে শুধু। আগুনের স্তম্ভ দেখার জন্য এখন আর ছাদে উঠতে হয় না। দোতলার জানালা দিয়েই বেশ দেখা যায়। কালো ধোঁয়ায় রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের অনেকখানি আচ্ছন্ন।
আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “....... টেলিফোন বিকল, রেডিও পঙ্গু, বাইরে কারফিউ- গোলাগুলির শব্দের চোটে প্রাণ অস্থির, বাইরে কি হচ্ছে কিছুই জানবার উপায় নেই।
ছাব্বিশে মার্চের পরিস্থিতি নিয়ে একই ধরনের কথা উঠে এসেছে সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডায়েরি বইতেও। সেদিন দশটার পর তিনি দিনের ঘটনাবলী তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
তিনি লিখেছেন, গতকাল রাত পৌনে ১২টায় হঠাৎ চট্টগ্রাম ফোন এল, ঢাকায় কোন গণ্ডগোল হচ্ছে কি না। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। ফোনটা রাখা মাত্র পুলের উপর মা বলে একটি আর্তনাদ শোনা গেলো, পরপর মেশিনগানের শব্দ ও জয়বাংলা শব্দের পর অবিরাম রাইফেল বোমা স্টেনগান মেশিনগান এর শব্দ, সাত মসজিদ, ইপিআর এর দিক থেকে গোলা কামানের শব্দ, জয় বাংলা আল্লাহ আকবর এর আওয়াজ ২টা পর্যন্ত হলো, তারপর থেকে শুধু কামান গোলার শব্দ, রাত সাড়ে তিনটায় মিলিটারি ভ্যান বাড়ীর সামনে এসে আবার চলে গেলো”।
তিনি আরও লিখেছেন, “কাল থেকে কারফিউ জারি। শোনা যাচ্ছে, মুজিব বন্দী। ও দিক থেকে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। আজ রাত দশটা পর্যন্ত। রেডিওতে ইয়াহিয়া ভাষণ দিল। আওয়ামী লীগ বন্ধ। মুজিব শর্তে আসেননি, সামরিক শাসন অমান্য করেছেন বলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মেশিনগানের শব্দ আসছে। মানুষের শব্দ কোথাও নেই, ঘর থেকে বের হতে পারছি না।
তবে যেখানে টেলিফোন সক্রিয় ছিল, সেখানেই ছাব্বিশে মার্চের কারফিউর মধ্যেও অনেক মানুষ চেষ্টা করছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছে, শেখ মুজিবের কী অবস্থা, কত মানুষ মারা গেছে -এসব খবরাখবর নিতে।
মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কাকরাইল-পল্টন এলাকায় ছিলেন। তিনি বলেন, পঁচিশে মার্চের রাতে বন্ধুর বাসায় ছিলাম। সকালে বেরিয়ে পল্টন এলাকায় অলিগলি দিয়ে বেরিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। ডেডবডি পড়েছিলো এখানে সেখানে, এমনকি ড্রেনেও। আগুন জ্বলছিলো এদিক সেদিক। পাকিস্তানি সেনারা এদিক সেদিক ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছিল বাড়ি ঘর লক্ষ্য করে। জানালায় দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে সেদিন।
অন্যদিকে শহরের রাস্তায় ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর টহল। যত্রতত্র শোনা যাচ্ছিলো গুলির শব্দ আর শহর জুড়ে এখানে সেখানে পড়েছিলো মৃতদেহ।
এভাবেই সূচনা হয় একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের, যার সমাপ্তি হয় সেই বছরের ষোলই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
সূত্র: বিবিসি