অমর একুশে বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের ৮০৫ থেকে ৮২০ পর্যন্ত স্টলগুলো একটু ভেতরের দিকে হওয়ায় এদিকে পাঠক বা দর্শনার্থীদের খুব বেশি আনাগোনা নেই। তবে যদি কেউ এই দিকে হেঁটে যান তাহলে ৮০৯ নম্বর স্টল দেখে স্বাভাবিকভাবেই থমকে দাঁড়াবেন। এই স্টলটিকে পাঠাগারের রূপ দেয়া হয়েছে। আর এই পাঠাগারের প্রকৃতি এবং স্টলে বিপণনকর্মী হিসেবে থাকা দুই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই তাদের থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করবেন। অনেকে থমকে দাঁড়াচ্ছেনও।
স্টলে থাকা বইয়ের তাকগুলোতে ঘুণ ধরেছে। যখন-তখন যেন ভেঙে পড়বে। বইগুলোর মলাটে ধুলোর আস্তরণ। পৃষ্ঠাগুলো খেয়ে ফেলছে পোকা। পড়ে আছে ভাঙা চেয়ার ও টেবিল। প্রবেশ পথের নামফলকেও ধরেছে মরিচা। দেখে মনে হবে যেন এই বুঝি নামফলকটা খসে পড়বে। অযত্ন, অবহেলার একটা ছাপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এই স্টলটিতে।
কথা বলে জানা যায়, এই স্টলটি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের। স্টলের এই প্রকৃতির মাধ্যমে তারা সমাজে একটা বার্তা দিতে চায়।
কী সেই বার্তা জানতে চাইলে স্টলে থাকা বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শত শত পুরাতন পাঠাগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বইয়ের অভাবে। বই না থাকায় পাঠক থাকেন না। আর পাঠক না থাকলে পাঠাগার থাকে না। আমাদের এই স্টলের ডিজাইনের মাধ্যমে আমরা সেসব পাঠাগারের চিত্রই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেসব পাঠাগারকে জাগিয়ে তুলে তার নতুন রূপে ফেরাতে আমাদের এই উদ্যোগ।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে যখন একজন একটা বই কিনছেন, সঙ্গে সঙ্গে উনাকে আমরা সেই বইয়ের একটা কপি ফ্রি দিচ্ছি। আর সেই ফ্রি বইতে উনি একটা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে আমাদের কাছে ডোনেট করে যাবেন। এরপর সেই বইটি গ্রামের কোনো জীর্ণ পাঠাগার, বৃদ্ধাশ্রম, মাদরাসা বা এতিমখানার পাঠাগারে পাঠানো হবে। যেখানে পাঠাগার ভেঙে গেছে বা নতুন পাঠাগার নেই, সেখানে আমরা নতুন পাঠাগার বানিয়ে দেব। এই পর্যন্ত আমাদের পাঁচশরও অধিক বই সংগ্রহ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে যে বইগুলো বিক্রি করছি সবগুলো আমাদের প্রকাশনীর বই। বিদ্যানন্দের একটা প্রকাশনী আছে। ছয় বছর ধরে আমরা বইমেলায় প্রকাশনী স্টলও পাচ্ছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে ৩৫০ নম্বর স্টলটি বিদ্যানন্দের।’
এই স্টলের আরেকটি ব্যতিক্রমী দিক হলো, এই স্টলে বিপণনকর্মী হিসেবে যাদের রাখা হয়েছে তারা দুজনই দৃষ্টিহীন। পাঠকদের তারা বই কিনে একটি বই ডোনেট করার আহ্বান করছেন। আর কোনো ক্রেত এলে তাদের স্টল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করছেন।
এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এই দুই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে রাখার মাধ্যমে আমরা সমাজে একটা বার্তা দিতে চাচ্ছি। অনেক সময় যারা প্রতিবন্ধী আছে তাদের সমাজ থেকে পিছিয়ে রাখা হয়। উনারা আসলে দেশের সম্পদ। উনাদের যেন পিছিয়ে না রাখা হয়, সেই বার্তা দিতে আমরা তাদের রেখেছি।’
বিদ্যানন্দের এই স্টলে থাকা দুই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির একজন মোহাম্মদ মহসিন। তিনি নীলফামারির ছেলে। এবার তিনি সরকারি বাংলা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ফাইভও পেয়েছেন।
মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘বিদ্যানন্দ আজকে যেভাবে দুজন প্রতিবন্ধী মানুষকে সেলসম্যান হিসেবে নিয়োগ করেছে, এভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের জায়গা থেকে প্রতিবন্ধীদের কাজ দেয় তাহলে প্রতিবন্ধী মানুষ সমাজের বোঝা হবে না বরং সমাজের সম্পদে পরিণত হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আল আমিন বিদ্যানন্দের এই স্টল থেকে দুইটা বই কিনেছেন। বিদ্যানন্দের এই ব্যতিক্রমী স্টল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিদ্যানন্দ মানবিক কাজের মাধ্যমে দেশে তাদের সুন্দর একটা ইমেজ তুলে ধরেছেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা একুশে পদকও পেয়েছে। এই স্টলটিও খুব সুন্দর উদ্যোগ। কমবেশি সবাই তো বই কিনছেন। কিন্তু একটা বই কেনার মাধ্যমে যদি আরেকটা পাঠাগারে একটি বই ডোনেট করার সুযোগ হয় তাহলে তো এটি ভালো লাগার বিষয়। ভালো কাজও। অবশ্যই এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’