শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন। পুষ্টিহীন খাবার যেমন শরীরের কোনো কাজে লাগে না। তেমনি জ্ঞান অর্জনবিহীন শিক্ষা শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরও শিশু শিক্ষায় বেসরকারি তথা কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে একুশের চেতনাকে সমুন্নত রেখে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
শিশুশিক্ষা হলো জাতির হৃৎপিণ্ড। মাতৃভাষাই হলো শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের অন্যতম বাহন। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় জ্ঞান অর্জন সমৃদ্ধ বা বিকশিত হয় না। জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে শীর্ষস্থান দখলের জন্য জ্ঞানচর্চাই হলো অন্যতম পথ। মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষায় জ্ঞান অর্জন অনেক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা পায় না। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, ‘বিনা স্বদেশি ভাষা মিটে কি মনের আশা?’ ঘাটতি জ্ঞান নিয়ে বিশ্বে বড় ধরনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ যেনো বাঙালি জাতির সংগ্রামের ও ইতিহাসের স্বীকৃতি। পাশাপাশি গর্ব ও অহংকার।
তাই ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের একুশের আত্মত্যাগ সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে ৫-১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ডেকে এনে তাইরে-নাইরে করে কোনোরকম সরকার বা সংশ্লিষ্টদের দেখানোর মতো দায়সারা অনুষ্ঠান করে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বাধীনতার প্রথম ভিত একুশের সংগ্রামী ইতিহাস না জেনে বেড়ে ওঠে। অপরদিকে, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে যে, শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানেন না। বাস্তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির তালিকায় বন্ধ রেখে তাদের জানার অধিকার হরণ করছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক ছুটির তালিকা থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বাদ দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা উচিত। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে। বেসরকারি তথা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ৪-৫ বছরের শিশুদের ওপর কঠিন কঠিন শব্দের ইংরেজি, আরবি ভাষার বাণিজ্যিক বই চাপিয়ে দেয়। আমাদের সর্বস্তরের বেশির ভাগ জনগণের সন্তানের লেখা পড়া শুরু হয় ইংরেজি, বাংলা বর্ণমালা ও আরবি হরফ দিয়ে। শিশু হাতের সামর্থের কথা বিবেচনা না করেই চলে অভিভাবকদের জোরজবরদস্তি। কিন্তু, এ বয়সে শিশুরা স্লেট, পেন্সিল, চক বা রং পেন্সিল দিয়ে নিজের খেয়াল খুশি মতো শুধু আঁকাআঁকি করবে। তাদের ওপর অক্ষরের আকৃতি বানানোর চাপ সৃষ্টি করা কাম্য নয়।
বর্তমানে শিক্ষাবান্ধব সরকার তেলা মাথায় তেল দিয়ে ভালো স্কুল তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধে ভর্তিতে লটারি প্রথা চালু করেছে। সঙ্গে বন্ধ হয়েছে শিক্ষার্থীদের কোচিংসহ লাখ লাখ টাকার ভর্তি বাণিজ্য।
সম্প্রতি এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সময় তাৎক্ষণিকভাবে আমি উপস্থিত হই। তিনি ৫ বছরের শিশুকে বাংলা, ইংরেজি বর্ণমালা লিখতে দিলেন। শিশু তার মতো করে সঠিক আকৃতি না লিখে জমা দিলেন। শিক্ষক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘স্যার, গার্ডিয়ানরা ভালোভাবে বর্ণমালা না শিখিয়ে ভর্তির জন্য নিয়ে আসেন। আমি শিক্ষককে প্রশ্ন করলাম, বলুন তো কারা, ইচ্ছা থাকলেও যথাযথভাবে লিখতে পারছেন না? শিক্ষকের যথাযথ উত্তর না জানা থাকায় আমি উত্তর দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, প্রবীণ ও একেবারে ছোট শিশুদের হাতে কলম ধরার স্বাভাবিক ক্ষমতা নেই। আমাদের লেখা আপনাদের মতো যথাযথ আকৃতির হবে না। সাধারণত অভিভাবকেরা শিশুর বর্ণমালা লেখা ও পড়া নিয়ে ৬ মাস বা বছর অতিক্রম করে থাকেন। অথচ যথাযথ বয়স হলে সে লেখা ১ মাসে লিখতে পারবেন। চিকিৎসকরা ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ ছাড়া শিশুকে অন্য খাবার না খাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তারপর ধীরে ধীরে মায়ের দুধের পাশপাশি তরল খাবারের পরবর্তীকালে শক্ত খাবারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আজকাল বেশিরভাগ পরিবারের ৬ মাসের পর শিশুর ওপর চলে নির্মম যন্ত্রণা। শিশুর খাবারের থলি অতি ক্ষুদ্র। অথচ অনেক অভিভাবকদের মাঝে এই উপলব্ধিবোধ নেই। তাদের ধারণা বেশি বেশি খাবার খাওয়ালে শিশু বেশি বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ হবে। তেমনি অভিভাবকদের ধারণা শিশু বেশি বেশি ইংরেজি, আরবি, সাধারণ জ্ঞান, ব্যাকরণ, ওয়ার্ড বই পড়ালে বেশি শিখবেন। বাস্তবে এ ধারণা সঠিক নয়। সৃষ্টিকর্তা নামাজ, রোজা, বিয়েসহ সকল কাজের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তেমনি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বয়স শ্রেণি, রুচি ও সামর্থ্যনুযায়ী আমাদের পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করার কাজ যাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পাঠ্য বইয়ে ১ম শ্রেণিতে ইংরেজি বাংলা সপ্তাহের বারের নাম, মাসের নাম, এমনকি আরবি মাসের না সৌরজগৎসহ নানা কঠিন বিষয় শিশুকে মুখস্থ করিয়ে অভিভাবকদের বাহবা অর্জন করে থাকে।
শিশুকে প্রথম জ্ঞান অর্জন করতে হবে তার পরিবেশভিত্তিক। ধীরে ধীরে এর আওতা বৃদ্ধি পাবে। শিশু পরিবেশ সম্পর্কে যতো বেশি জানবেন, তার ততো মেধার বিকাশ ঘটবে। শিশুর শিক্ষায় আনন্দদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে তার বয়স উপযোগী ছড়া, কবিতা, গল্প খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে। বর্ণ ক্রমিক পদ্ধতিতে শিক্ষার আনন্দ সৃষ্টি হয় না। সহজ সহজ শব্দের বা বাক্যের মাধ্যমে শিশুর আনন্দ ও মেধা শক্তি জাগ্রত হয়। প্রথমত: শব্দ ভেঙে এলোমেলোভাবে বর্ণ শেখাতে হবে। পরবর্তীকালে শিশু সেগুলো সাজিয়ে পড়বেন ও লিখবেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের পরিধির ব্যাপকতা বাড়াতে হবে। তাই শিশুর মেধার বিনাশে বাণিজ্যের নামে অপশিক্ষা দ্রুত বন্ধ হোক। একুশের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থা সমৃদ্ধ হক।
লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।