এপার বাংলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ

ওয়ালিউর রহমান বাবু |

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকো জমিদার পরিবারে। এপার বাংলায় পরিবারটির জমিদারি ছিলো। এপার বাংলার রাজশাহী জেলার তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার আত্রাই থানার কালিগ্রামে জমিদারি দেখা শোনার দায়িত্ব পেয়ে কবি এখানে আসেন। প্রথম দিকে কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে অস্বস্তি বোধ করতেন, যা তিনি তার লেখা চিঠিতে স্বজনকে জানান। 

ওয়ালিউর রহমান বাবু

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ, তখন শীতকাল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন তৎকালীন নওগাঁর আত্রাই থানার কালিগ্রামে। কিছুদিন পরে যান পাশের গ্রাম পতিসরে। কবি কখনো এপার বাংলার পাবনার শাজাদপুরে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কখনো আবার ওপার বাংলায় অবস্থান করেন। কবির অনেক গুণের একটি ছিলো যেখানে যেতেন যা দেখতেন যাদের সঙ্গে মিশতেন সবকিছু চিঠিতে লিখে স্বজনদের জানাতেন। একসময় তার মনে পরিবর্তন আসে স্বজনকে জানান এখানে তার ভালো লাগছে, সবকিছু সুন্দর। তখন দূরে যাওয়া-আসার মাধ্যম ছিলো নৌকা বা ট্রেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখা শোনার পাশাপাশি নিজেকে লেখালেখিতে যুক্ত রেখে গ্রাম, সমাজ, উন্নয়ন এবং গ্রামের মানুষের আত্মনির্ভরশীল করার কথা ভাবেন। বিদেশে পড়ার সময় তার ঘনিষ্ঠতা হয় সহপাঠী বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের সঙ্গে।

১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে এই বন্ধুর আমন্ত্রণে তিনি রাজশাহী জেলা সদরে আসেন। লোকেন্দ্রনাথ পালিত তখন রাজশাহীর জেলা জজ। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন কবিকে রাজশাহী কলেজের সাহিত্য সভায় আমন্ত্রণ জানালে কবি রাজশাহীতে এসে লিখেন ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধর। ২৬ নভেম্বর কলেজ শিক্ষক লাউঞ্জে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের সভাপতিত্বে কবি প্রবন্ধটি পাঠ করেন। এটি ছিলো শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে তার লেখা। আলোচনায় অংশ নেন জেলা জজ কবির বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ, অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার, শিক্ষাবিদ সৈয়দ আব্দুস সালেক, শিক্ষাবিদ কুমুদিনী কান্ত ব্যানার্জী এবং সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী। বিষয়টি ওপার বাংলাতেও আলোচিত হয়, সংবাদপত্রে সংবাদ ছাপা হয়।

ছবি আঁকতে হাতের আঙুল তালু জল রং ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেন। জানা যায় তার আঁকা ছবির সংখ্যা ৩ হাজারের মতো। ইংরেজদের আচরণ ভারত বর্ষের মানুষকে অভিশপ্ত করে তুললে পতিসর থেকেই লেখার মাধ্যেমে আন্দোলন শুরু করে লিখলেন ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধ, যা পরবর্তীতে কলকাতার বিভন স্কয়ার লিটারি ও চৈতন্য ক্লাবের আয়োজনে বক্রিমচন্দ্রের সভাপতিত্বে অ্যাসেম ক্লিজ ইনস্টিটিউটে পাঠ করে কবি সমলোচিত হয়েও থেমে যাননি। শুরু হলো তার রাজনৈতিক প্রবন্ধে লেখা।

ফাল্গুন মাস সবার মতো কবি ও আলোড়িত হয়ে লিখলেন ‘সন্ধ্যা’ কবিতা। ‘এবার ফেরাও মোরে’ লেখার কথা ভাবলেও পতিসরে তা না লিখে তা লিখলেন রাজশাহী জেলা সদরে এসে বন্ধু পালিতের বাড়িতে। শাহাজাদপুর হয়ে গেলেন পতিসরে। জমিদারি দেখা শোনা ও কিছু কাজ শেষ করে আবার বন্ধু পালিতের বাড়িতে। কবি বেশ কয়েকবার রাজশাহী জেলা সদরে আসেন যা অনেকেরই অজানা। এপার বাংলার প্রকৃতি, ঋতু মানুষ, পরিবেশ কবিকে আকৃষ্ট করে ফেলে কবির লেখালেখির গতি বেড়ে যায়। কবির প্রিয় জায়গা হয়ে গেলো পতিসর, নাগর নদী আত্রাই নদী নাটোরের চলনবিল, পাবনার শাহাজাদপুর এবং কুষ্টিয়ার শিলাইদহ।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন। রাজশাহী জেলার তৎকালীন নাটোর মহাকুমার কংগ্রেসের সম্মেলনে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করে বক্তব্য ও কার্যবিবরণী বাংলায় করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ন্ত্রক ব্যাক্তিবর্গ কবির সমালোচনা ও উপহাস করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজি জানেন না, বোঝেন না। এ কথা শুনে কবির মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি, বরং তার লেখালেখির হাত শাণিত হলো। আষাঢ় মাসে পতিসরে লিখলেন ‘বঙ্গলক্ষী’, ‘শরৎ’ আত্রায়ে লিখলেন ‘হত ভাগ্যের গান’, ‘মাতার আহ্বান’। পতিসরে তার লেখা ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় কবি সাধারণ মানুষদের ওপর ক্ষমতাশালীদের অত্যাচার নির্যাতন তুলে ধরেন।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং সাধক ফকির লালন শাহের সঙ্গে কবির নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। কৃষক প্রজা সাধারণ মানুষের দুঃখজনক অবস্থা দেখে কবি তাদের খাজনা মাফ করে দেন। অনেকে তাকে সাম্পদায়িক কবি বলেন। কিন্তু তিনি কী ছিলেন তা তার নিবেদিত কাজ থেকে বোঝা যায়। পাবনায় কংগ্রাসের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি সামাজিক তথা গ্রাম উন্নয়নের ভাবনার কথা তুলে ধরে কয়েকটি দিক উপস্থাপন করেন। তা ছিলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ উন্নয়নে রাস্তা মেরামত, পানির জন্য কুপ খনন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষকদের রক্ষা করা। এসব পরিচালনার জন্য কমিটিও গঠন করে দেন। সেখানে এ কার্যক্রম সফল না হওয়ায় তা পতিসরে নিয়ে আসেন তিনি। এখানে স্থাপন করেন কৃষি ব্যাংক ও সমবায় পদ্ধতি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় পতিসরবাসী তাকে সংবর্ধনা দেন। কবি নোভেল পুরস্কারের সম্মানী হিসেবে পাওয়া টাকা ও বই লেখার সম্মানী এই ব্যাংকে দিয়ে দেন। মহাত্মা গান্ধিও কবির কিছু উপদেশ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ভালো সস্পর্ক থাকলেও বিবেধ ছিলো। গান্ধী চাইতেন চরকাটার মাধ্যেমে শ্রমের বিকল্প আর কবি চেয়েছিলেন সমবায়ের মাধ্যেমে সমাজ গড়তে।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পদায়িক ছিলেন না। তার কথা ধর্ম নিজস্ব সত্তা। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম দিবসে তিনি মহানবীর মহত্ব বর্ণনা করে বিবৃতি দেন, যা ওপার বাংলার কলকাতার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে তিনি বলেন, ভারতবর্ষ ধর্ম নিরপেক্ষ ও সব মানুষের আত্মসম্মান বোধ আছে। তিনি লেখেন ‘ধর্মের নব যুগ’। কবির উদ্যোগে পতিসরে রেশম চাষ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। শিক্ষার উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনি শুধু কবি, লেখক ও সাহিত্যিক নন। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারকও। পতিসর থেকে তিনি আত্রায়ে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে স্বদেশী আন্দোলন ও নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। কবি ব্রিটিশদের নির্যাতনের প্রতিবাদে তাকে দেয়া ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন।

আজ যে স্লোগান দেয়া হয় ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ এটি ছিলো কবিরই ভাবনা। আরেকটি বিষয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নেয় তখন তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওপার বাংলার কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে মুসলমানদের হাতে রাখী পরিয়ে দেন। অনেকে বলেন কবি জমিদার পরিবারের সন্তান বড় লোকদের কবি। বাম রাজনীতি করা অনেকেই একি মতো ঘোষণা করেন। 

কবির সঙ্গে এপার বাংলার বহু মানুষের ঘনিষ্ঠতা হয়। তাদের স্মৃতিময় কথাগুলো যদি সংরক্ষণ করা যেতো তাহলে খুবই ভালো হতো। এপার বাংলার ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন নেত্রকোণা মহকুমার মোহনগঞ্জ থানার বাহন গ্রামের বিশেষ ব্যক্তির শিক্ষাবিদ আইনজীবী, সংগীত গুরু আচার্ষ শৈলজা রঞ্জনের সঙ্গে একান্ত ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। কবি তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। তিনি কবিগুরুর বিলুপ্ত হওয়া গানগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। কবিগুরুর প্রায় দুইশ গানের স্বরলিপিকার তিনি। কবিগুরুর গানই আমাদের জাতীয় সংগীত। জানা যায়, একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কয়েকজনকে নিয়ে বসে ছিলেন। একজন এসে তাকে কী যেনো বলেলে তিনি সবাইকে জোরে জোরে কবিগুরুর লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে বললেন। এই গানটি এখন আমাদের জাতীয় সংগীত।

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী ও গবেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034830570220947