মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি সাধারণভাবে ‘শিক্ষা ভবন’হিসেবে পরিচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এই শিক্ষা ভবন দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের আখড়া হিসেবে সমালোচিত। এদিকে সেবা বিকেন্দ্রীকরণ ও সহজীকরণের কথা বলে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে এমপিও ব্যবস্থা মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর হাতে ছেড়ে দেয় সরকার। কিন্তু ছয় বছর পর এসেও দুর্নীতির একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের দিয়েই এসব অভিযোগের তদন্তকাজ করানো হচ্ছে। যে কারণে দুর্নীতি তো কমছেই না বরং সময়, শ্রম ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের। এর কারণে মাউশির এ সেবা বিকেন্দ্রীকরণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তার সাম্প্রতিকে কয়েকটি প্রতিবেদনে সেবা বিকেন্দ্রীকরণের পরও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর এমপিওভুক্তি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) পেতে কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিসে লাখ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েও সারা দেশের অনেক শিক্ষকের এমপিওভুক্ত না হওয়ার খবর মিলেছে। ঘুষ গ্রহণকারীরা এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী। এভাবে সারা দেশে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মাউশির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি শিকার হয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। মাউশির কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া এমপিওভুক্তি, শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্নীতি, এমনকী মাউশির জেলা, উপজেলা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত দুর্নীতির শত শত লিখিত অভিযোগ জমা পড়ছে মাউশিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাউশি কর্মকর্তারা বলছেন, সেবা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মাউশি থেকে এমপিও আঞ্চলিক কার্যালয়ে নেয়া এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারণ এমপিওভুক্তির দায়িত্বে থাকাকালে ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল মাউশি অধিদপ্তর। এ বদনাম ঘোচাতে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই আঞ্চলিক পর্যায়ে এমপিওভুক্তির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত ছয়মাসে দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে কয়েকশত চিঠি এসেছে, যার প্রায় সবই শিক্ষকদের ভুয়া এমপিওভুক্তির বিষয়ে। এছাড়া রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে অবাধ দুর্নীতির অভিযোগ। দেখা যাচ্ছে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরেক শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি মাউশিতে এসব অভিযোগ পাঠাচ্ছেন। জনবল সংকটের কারণে মাউশির সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো এসব যাচাই-বাছাই করতে হিমশিম খাচ্ছে। এমপিওভুক্তির কাজ আঞ্চলিক কার্যালয়ে হলেও এ থেকে লাভবান হন মাউশির কর্মকর্তাদের অনেকেই। এমপিও যার কাছে, দুর্নীতি তার কাছে এ কথা শিক্ষা দপ্তরের সবাই জানে। অবস্থা যদি এই হয় তাহলে দুর্নীতি বন্ধ হবে কী করে?
লক্ষ করা দরকার, মাউশি ছাড়াও গত তিন বছরে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ২৪৪টি দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এর মধ্যে নানা সময়ে ১৮৪টি অভিযোগ তদন্তে মাউশিকে দায়িত্ব দিয়েছিল সংস্থাটি। তদন্তের অগ্রগতি ও প্রতিবেদন পাঠাতে ৪০টি চিঠি মাউশিকে পাঠায় দুদক। কিন্তু কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে গত বুধবার মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) সৈয়দ গোলাম ফারুককে তলব করে দুদক। এরপর গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এসব তদন্ত প্রতিবেদন না পাঠালে মাউশির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন সংস্থাটি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে মাউশি বা শিক্ষা ভবনে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে অনিয়ম ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৮৬ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। একই বছর শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতির আরেক অভিযোগে শিক্ষা ক্যাডারের ৩০ কর্মকর্তাকে বদলির সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে বদলি করার জন্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর স্বাক্ষর জালের ঘটনাও ঘটে মাউশিতে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, মাউশির এই লাগাতার দুর্নীতির খুঁটির জোর এলো কোথা থেকে? এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেশে শিক্ষার মানের ওপরও সরাসরি প্রভাব ফেলছে। প্রশ্ন হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাউশির এমন লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?লেখক : হাবিবুর রহমান, শিক্ষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়