এমপিও শিক্ষকদের বদলি না থাকায় কাটছে না শিক্ষক সংকট

রুম্মান তূর্য |

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি পদ্ধতি চালুর দাবি দীর্ঘদিনের। ২০১৮ ও ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জারি হওয়া এমপিও নীতিমালায় শিক্ষকদের বদলি পদ্ধতি চালুর কথা বলা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে, দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে শিক্ষকরাও হাপিয়ে উঠেছেন। বর্তমান করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে বদলি পদ্ধতি চালু না হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষার মানোন্নয়ন। দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সংকট সৃষ্টির মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বদলি পদ্ধতি না থাকা। প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আশায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে অন্যপদে নিয়োগ সুপারিশ পাচ্ছেন। এতে করে একটি পদ খালিই থেকে যাচ্ছে। ফলে একদিকে শিক্ষক সংকট কাটছে না, অপর দিকে নিয়োগ পাচ্ছেন না নিবন্ধিত বেকাররা। দীর্ঘকালীন শিক্ষক সংকট শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দীর্ঘ বেকারত্ব হতাশা বাড়াচ্ছে নিবন্ধিতদের। শিক্ষক সংকট নিরসনে বদলি পদ্ধতি চালু জরুরি বলে মত দিয়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষক নিবন্ধিনধারীরা।

দীর্ঘ দুই বছর পর শিক্ষক সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩১ হাজার ২৮৬ জন নিবন্ধিত প্রার্থীদের শিক্ষক পদে নিয়োগে প্রাথমিক সুপারিশ করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। কিন্তু গণবিজ্ঞপ্তি ও এমপিও নীতিমালায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নতুন করে নিয়োগের আবেদন করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। এতে করে এ নিয়োগে বেশিরভাগ ইনডেক্সধারী প্রার্থী (ইতোমধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক) নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন সাধারণ নিবন্ধিত প্রার্থীরা। এতে বেকার নিবন্ধিতরা তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ পাননি। তাদের অভিযোগ, ইনডেক্সধারী অর্থাৎ এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নিজেদের একটি পদ খালি করে অপর একটি পদে নিয়োগ সুপারিশ নিয়েছেন। এতে করে একটি পদ শূন্যই থাকছে। এ পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক পদে নিয়োগ সুপারিশ করা হলেও শিক্ষক সংকট নিরসন হয়নি। আর বেকার নিবন্ধিতরাও নিয়োগ সুপারিশ পাননি। অনেক ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত অনেক শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পেলেও সে পদে যোগদান করবেন না। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকা পদগুলো খালিই পড়ে থাকছে।  

যদিও ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি পদ্ধতি চালু না হওয়ায় তারা গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করছেন। নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব এনটিআরসিএর হাতে আসার আগে ইনডেক্সধারীরা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারতেন। দীর্ঘদিন দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরির পর নিজ জেলা বা উপজেলার প্রতিষ্ঠানে চাকরির আশায় তারা নিয়োগের আবেদন করেছেন। যারা বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন তারা যোগদান করবেন। তবে, যারা কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাননি তাদের অনেকে যোগদান করবেন না। শিক্ষকরা বলছেন বদলি পদ্ধতি চালু থাকলে তারা বদলি হতেন, নিয়োগের আবেদন করতেন না। এতে করে শিক্ষক সংকট নিরসনের পথ সুগম হতো। নিবন্ধিত বেকাররাও শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পেতেন।

এদিকে কতজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক নতুন করে শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন সে হিসেব নেই এনটিআরসিএর হাতে। তবে কর্মকর্তারাও বদলি পদ্ধতির অভাব অনুধাবন করছেন। তারা বলছেন, ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে এবং বদলি প্রথা চালু না হলে চলমান শিক্ষক সংকট নিরসন সম্ভব নয়। 

দীর্ঘ দুই বছর পরে ৫৪ হাজারের বেশি পদে শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। সর্বশেষ জারি করা এমপিও নীতিমালা অনুসারে এ নিয়োগে ইনডেক্সধারী অর্থাৎ ইতোমধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নিয়োগ সুপারিশ পেতে আবেদন করার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে নিয়োগ সুপারিশও পেয়েছেন তারা। তবে অনেকে যোগদান করছেন না। 

জামালপুর সদর উপজেলার মামুন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে এ গণবিজ্ঞপ্তিতে তিনজন শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। তবে, তাদের মধ্যে দুইজন ইনডেক্সধারী ও একজন সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়ায় যোগদান করতে চাচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসিএতে চাহিদা দিয়েছিলেন। এ পদগুলোর একটি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে খালি হয়। কিন্তু যারা সুপারিশ পেয়েছেন তাদের মধ্যে দুইজন ইতোমধ্যে মাদরাসায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। আর অপরজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই কেউই প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদান করতে চাচ্ছেন না। তাই তার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদ পূরণ হচ্ছে না।

তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, সুপারিশ পাওয়া শিক্ষকরা ইতোমধ্যে এমপিওভুক্ত হওয়ায় তারা নিয়োগ সুপারিশ পেয়ে যোগদান করতে চাচ্ছেন না। কেউ বেসরকারি বেতন কত তা জানতে চাচ্ছেন, কেউ জানতে চাচ্ছেন কতজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এ পরিস্থিতিতে ইনডেক্সধারীদের সুপারিশ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও হয়রানি করা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, বিজ্ঞান ও ধর্ম কে পড়াবেন তা জানেন না এ প্রধান শিক্ষক। তিনি দৈনিক আমাদের বার্তার মাধ্যমে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইনডেক্সধারীদের যেন নিয়োগ সুপারিশ না করা হয় সে দাবি জানিয়েছেন। 
  
দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে কথা হয় শিক্ষক পদে নতুন সুপারিশ পাওয়া ইনডেক্সধারী কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে। তারা বলেন, বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে পোস্ট খালি থাকায় আবেদন করেছিলেন। তাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন তারা আগের প্রতিষ্ঠান থেকে পদ ছেড়ে সুপারিশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানে যোগদান করবেন। কেউ এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তবে যোগদান করুন আর নাই করুন, তারা সুপারিশ পাওয়ায় একটি শিক্ষক পদ যে খালিই থাকছে সে বিষয়ে অবগত তারা। 

বরগুনার আমতলী উপজেলার একটি মাদরাসার শিক্ষক আলআমিন। তিনি সম্প্রতি একটি স্কুলে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেছেন, নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করায় তার পদটি শূন্য থাকছে। কিন্তু স্কুলের গণিত শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে তিনি যোগদান করছেন। বদলি পদ্ধতি চালু হলে আবেদন করতেন না বলেও জানান তিনি। বলেন, বদলি পদ্ধতি চালু থাকলে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে না। তাই শিক্ষক পদটিও শূন্য থাকতো না। 

এবিষয়ে কথা বলতে দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় এনটিআরসিএর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে। তারা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এমপিও নীতিমালা অনুসারে তারা নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদন গ্রহণ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ দেওয়ায় তারা আবেদন নিয়েছেন। তবে, ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ দেওয়ায় শিক্ষক সংকট যে কাটছে না তা অনুধাবন করছেন তারা। তারা বলছেন, বদলি পদ্ধতি চালু না হওয়ায় এ জটিলতা হচ্ছে। বিধি-বিধান পরিবর্তন করা না হলে এ জটিলতা কাটবে না। 

কিছুদিন আগে এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগের নীতিমালার মত সংশোধিত নতুন নীতিমালায় ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নীতিমালা সংশোধনের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয়ের এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অনেকেই জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে দূরের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের বদলি প্রথাও নেই। তারা যাতে বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করে আসতে পারেন তাই এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। 

তবে নীতিমালায় শিক্ষকদের বদলি চালুর সুযোগ থাকার পরেও তা চালু হচ্ছে না। এবিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি চালুর প্রস্তুতি শুরু হলেও বিষয়টি আটকে গেছে। এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনাও প্রয়োজন। বদলি চালু হলে শিক্ষক সংকট কাটবে তাতেও একমত হয়েছেন তারা। 

এদিকে সাধারণ নিবন্ধিতরাও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি চালুর দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, শিক্ষকদের বদলি চালু হলেও সুপারিশ পেয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বদলি হতে পারবেন। তারা আর নিয়োগের আবেদন করবেন না। এতে বেকাররাও শিক্ষক পদে সুপারিশ পেতে পারবেন বলে মন্তব্য করেছেন তারা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.010509014129639