এমপিওভুক্তি ঢাকায় না মফস্বলে

মো. নজরুল ইসলাম খান |

ব্যক্তির এমপিওভুক্তি ঢাকায় ফিরছে বলে নানা মাধ্যমে একটি খবর শোনা যাচ্ছে। আমি শিক্ষাসচিব এবং ফাহিমা খাতুন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক থাকাকালীন এমপিওভুক্তি সাতটি অঞ্চলে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। এর পেছনে একটি বড় ধরনের ঘটনা আছে। একদিন জানা গেল, মাউশির এমপিও শাখার কম্পিউটারে প্রায় ৩০০ জনকে এমপিওভুক্তির জন্য নাম ঢোকানো হয়েছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেল, এখন চিন্তা করা হচ্ছিল কিভাবে এগুলো দূর করা যায়।

কিন্তু সবার উপর মানুষ সত্য, প্রতিটা সিস্টেমের প্রধান পরিচালকও একজন মানুষ। তাই মানুষকে এমন একটা পদ্ধতির ভেতর আনতে হয় যেন সে তার বাইরে না যেতে পারে। কিন্তু যে মানুষের হাতে কাজ থাকে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আরও মানুষের দরকার হয়। তবে সেই মানুষগুলোর মধ্যে যদি লিয়াজোঁ হয়, এক ধরনের যোগসাজস হয় তবে তা বন্ধ করা খুবই কঠিন।

এই কথাগুলো মাথায় রেখে একটি সিস্টেম চালু করা হয়েছিল, সেটি একটি সফটওয়্যার। তবে যে কোন সিস্টেম প্রথমে চালু করলে তার কিছু অসুবিধা দেখা দেয় কিংবা যারা ব্যবহার করে তারা প্রথমে সেটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না। আর যদি দেখেন তাদের স্বার্থ, দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে তবে তারা আদাজল খেয়ে লাগেন, কিভাবে সেটি বন্ধ করা যায়।

এখন আসছি সিস্টেমটি কেমন ছিল। আজ থেকে ৬ বছরের বেশি আগের কথা হয়তো অনেকের মনে নাও থাকতে পারে। অনেক পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলে সেগুলি বদলির অফিসগুলোতে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন।

তবুও আমি এখানে কিছুটা উল্লেখ করতে চাই, সফটওয়্যারটা এমনভাবে তৈরি করা ছিল যে, যে স্কুল থেকে যে শিক্ষক এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করতে চান তাকে অবশ্যই সেই স্কুল থেকেই ওয়েব মেইলের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। এর দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হচ্ছে এই সুযোগে প্রতিটি স্কুলের একটি ওয়েবসাইট তৈরি হয়ে যাবে এবং ওয়েব মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চিঠিপত্র আদান-প্রদান হলে তার একটি সুন্দর ডকুমেন্টেশন থাকবে। আমরা লক্ষ্য করেছি অনেকে অনেক স্কুলে পড়েছেন কিন্তু তাদের কোনও তথ্য স্কুলে নেই। ওয়েবসাইট থাকলে সেখানে প্রয়োজনীয় সব তথ্য রাখা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, স্কুলের বাইরে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আবেদন করা যাবে না। আমি নিজেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার সেকথা বলেছি। বিধি-নিষেধ লিখিত আকারে দেয়া হয়নি এই কারণে যে তখনও সব স্কুলের ওয়েবসাইট ছিল না। আমি থাকা অবস্থায় ওয়েবসাইটের ব্যাপক কর্মকাণ্ড চলছিল, আমি লক্ষ্য করেছি, আমি চলে আসার পর সেগুলো আর মনিটরিং করা হয়নি।

সিস্টেমটি ছিল, এমপিও আবেদন প্রার্থী তার স্কুল থেকে আবেদনটি করবেন। আবেদনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইলেকট্রনিকভাবে সংযুক্ত করে দেবেন। প্রধান শিক্ষক সেটি ভেরিফাই করে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে সুপারিশ সহকারে একটি কভার লেটার দিয়ে পাঠিয়ে  দেবেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসার তার প্রয়োজন অনুযায়ী আবেদনটি যাচাই করে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠাবেন। তিনি নিজে যাচাই করবেন বা তার অফিসের কাউকে দিয়ে যাচাই করাবেন। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার প্রয়োজনবোধে আবারো অনুসন্ধান করতে পারবেন। তারপর সেগুলো বিভাগীয় পর্যায়ের মাধ্যমিক শিক্ষার উপপরিচালকের কাছে পাঠাবেন। তার পক্ষে হয়তো সব দরখাস্ত যাচাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু সময় সময়ে স্যাম্পল হিসেবে কিছু যাচাই করে দেখবেন। কোন ব্যত্যয় পেলে তিনি তার নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

এই সিস্টেমের সবচেয়ে বড় বিউটি হচ্ছে, প্রতিটি পর্যায়ের একটি করে ড্যাশবোর্ড। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, শিক্ষাসচিব কিংবা মাধ্যমিকের যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিব এবং মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রত্যেকের একটি করে ড্যাশবোর্ড থাকবে। সময়ে সময়ে সিস্টেমে কত দিনের ভেতরে কে যাচাই সম্পন্ন করবেন তা সেট করা যাবে। সর্বোচ্চ সাত দিন থেকে একমাস সময় দেয়া যেতে পারে। যদি এক মাসের ভেতরে এটি না করা হয় তবে এই আবেদনগুলো লাল দেখাবে। যার অধীনস্ত আবেদনে যত বেশি সংখ্যক লাল থাকবে তার পারফরম্যান্স তত খারাপ হবে। তাকে অবশ্যই দুর্নীতি বা অদক্ষতার ব্যাপারে সন্দেহ করা চলবে এবং তার বাৎসরিক রিপোর্টে তার প্রতিফলন থাকবে।

আর ওই রেকর্ড পুরোপুরি মুছে ফেলার কোন সুযোগ থাকবে না। ফেললেও সেটা ডেটা থেকে সেগুলো নির্ণয় করা সম্ভব, কার কার ওই কম্পিউটারে এন্ট্রি ছিল এবং কে সেখানে প্রবেশ করে কখন কি করেছে নির্ণয় করা যাবে। কেউ গাফিলতি কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কাউকে পাসওয়ার্ড দিলে  যিনি এন্ট্রি দিয়েছেন তাকেই ধরতে হবে।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে এবং ঊর্ধ্বতনরা যদি মাঝে মধ্যে ড্যাশবোর্ডগুলো দেখতেন এবং সে অনুযায়ী নির্দেশনা দিতেন তবে ঘুষের অভিযোগ বা সম্ভাবনা অনেক কমে যেত। দুর্নীতি করতে হলে সম্পর্কের প্রয়োজন হয়। সম্পর্ক গড়তে হলে সময়ের প্রয়োজন হয়। সম্পর্ক যাতে না গড়তে পারে সেজন্য ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নজর রাখতে হবে। ঊর্ধ্বতন যদি নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে তবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই সিস্টেমের মাধ্যমে বছরের পর বছর কাজ না হওয়া আগের সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়।

যারা এটি পরিবর্তন করতে চান তারা কি একবারও আগের ইতিহাসটা ঘেঁটে দেখেছেন? সেই ইতিহাস কি বর্তমানের চেয়ে আরও ভালো? আরও স্বচ্ছ? আরও দুর্নীতিমুক্ত? আরও হয়রানি মুক্ত? এমপিওপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের ঢাকায় আসা-যাওয়ায় আরও বেশি অর্থ ব্যয় কি হবে না? রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনার ঝুঁকি  কি বাড়বে না?

শিক্ষক তার নিজের প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারে কেন দেখতে পারবেন না তার দরখাস্তটি কোথায় কি পর্যায়ে আছে? নিদেনপক্ষে তার বাড়ির কাছের উপজেলা কর্মকর্তার কাছে কেন খোঁজ নিতে পারবেন না?

অভিজ্ঞতাটাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান সিস্টেমটাকে আরও আধুনিক করাটাই কি ভালো নয়? ভালো করে ভাবলে দেখা যাবে, পরিবর্তিত সিস্টেমই অনেক অনেক গুণে শ্রেয়।

লেখক : মো. নজরুল ইসলাম খান, সাবেক শিক্ষাসচিব প্রধান উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027239322662354