এমপিওভুক্তির আবেদন বেশি, বরাদ্দ কম : ভুয়া কাগজের ছড়াছড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিও) করতে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন চাওয়া হয়েছিল। এবার এমপিও পেতে সারাদেশের আট হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তত সাড়ে ছয় হাজার। বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্তর পরিবর্তনের আবেদন করেছে। এখন চলছে আবেদন যাচাই-বাছাই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে এমপিওভুক্তির যোগ্য সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সারাদেশে সাড়ে আট হাজারের বেশি। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৮৭ হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী নতুন এমপিওভুক্তির আশায় বুক বেঁধেছেন। এমপিওভুক্ত হওয়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে মাসে বেতনের মূল অংশ ও এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। এর বাইরে দুই ঈদে শিক্ষকরা মূল বেতনের ২৫ শতাংশ আর কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা পান। আবেদন নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে তিন ক্যাটাগরিতে আবেদন বাছাই শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত কমিটি। ১৫ নভেম্বর কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। 


কমিটির আহ্বায়ক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফৌজিয়া জাফরীন এনডিসি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির নীতিমালা ও জনবল কাঠামো-২০২১ অনুসারে প্রাপ্ত আবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। তিন প্রধান মানদণ্ড বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা দেখেছি, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে, যা দুঃখজনক। কতটি আবেদন জমা পড়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কতটি আবেদন জমা পড়েছে তারও চেয়ে গুরত্বপূর্ণ হলো কতটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেওয়া হবে। এটি বাজেট বরাদ্দের ওপর নির্ভর করছে। সরকার চাইলে বাজেট বাড়াতেও পারে। আমরা কমিটি থেকে যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাছাই করে সরকারের কাছে জমা দেব। সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।


জানা যায়, কমপক্ষে দুটি যোগ্যতা থাকলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারে। একটি হলো সরকারি স্বীকৃতি, অন্যটি প্রতিষ্ঠানের নিজ জমিতে নিজস্ব অবকাঠামো থাকা। অথচ স্বীকৃতিবিহীন বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার এমপিওভুক্ত হতে আবেদন করেছে। এ নিয়ে বাছাই কমিটির সদস্যরাও বিব্রত। কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ওইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রয়েছেন। হয়তো তারা মনে করেছেন, রাজনৈতিক তদবির করে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করিয়ে নেবেন। অথচ এবার সে সুযোগ নেই।
তিন মানদণ্ডে, ১০০ নম্বরে মূল্যায়ন :শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, এবারও গতবারের মতো বিশেষায়িত অটোমেটেড সফটওয়্যারে এমপিওর আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়ের (বুয়েট) তৈরি করা এই বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন নেওয়া হয়েছে ও বাছাই চলছে। প্রধান তিনটি মানদণ্ডে ১০০ নম্বরে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তিন ক্যাটাগরিতে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এ গ্রেডিং হবে। মানদণ্ডগুলো হলো- শিক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর), পরীক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর) এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার (৪০ নম্বর)।


এমপিও নীতিমালা-২০২১-এ এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঁচটি স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে। স্তরগুলো হলো- নিম্ন মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ থেকে ৮ম), মাধ্যমিক (৯ম থেকে ১০ম), উচ্চ মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ থেকে ১২তম), কলেজ (১১তম থেকে ১২তম), স্নাতক (পাস) তথা ডিগ্রি কলেজ (১১তম থেকে ১৫তম)।
এমপিও পেতে আবেদন করা স্কুল-কলেজগুলো বাছাইয়ে ৯ সদস্যের কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব ফৌজিয়া জাফরীন এনডিসি। কমিটিতে ব্যানবেইসের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কলেজ শাখার যুগ্ম সচিব, বেসরকারি মাধ্যমিক শাখার উপসচিব, মাউশির প্রশাসন শাখার পরিচালক, ঢাকা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক, বিভাগের বাজেট শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব সদস্য হিসেবে আছেন। আর মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি মাধ্যমিক-৩ শাখার উপসচিব কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। আর যাচাই কমিটিকে সহায়তা করতে চার সদস্যের একটি উপকমিটিও গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দীর্ঘ ৯ বছর পর দুই হাজার ৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছিল সরকার। তার মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শেণি) ৪৩৯টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) ১০৮টি ছিল। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শেণি স্তরের প্রতিষ্ঠান ৮৮৭টি, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬৮টি, কলেজ (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) ৯৩টি এবং ডিগ্রি কলেজ ৫৬টি এমপিওভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া মাদ্রাসা ছিল ৫৫৭টি। সেবার কোনো মন্ত্রী-এমপির ডিও লেটার আমলে নেওয়া হয়নি।
তার আগে ২০১০ সালে এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতিটি ডিগ্রি কলেজ এমপিওভুক্ত করতে বছরে সরকারের ব্যয় হয় ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের জন্য লাগে ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা, আর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাগে ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫০ টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৮ হাজার ৯১০টি। এর মধ্যে স্কুল ১৮ হাজার ১৯৭টি, কলেজ দুই হাজার ৩৬৫টি, মাদ্রাসা সাত হাজার ৬১৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ সরকার প্রতিমাসে ৯৪১ কোটি ৫০ লাখ ২৪ হাজার ৭১১ টাকা ব্যয় করছে।
এবার বরাদ্দ ২৫০ কোটি টাকা :জানা যায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমডিওভুক্তির খাতে এ বছর বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজের জন্য ২০০ কোটি এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫০ কোটি টাকা। সংশ্নিষ্টরা জানান, এ অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৬০০ থেকে ৭০০ প্রতিষ্ঠান বড়জোর এমপিওভুক্ত করা যেতে পারে। অথচ আবেদন বিপুল। তাই এ ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। না হলে চাহিদার তুলনায় খুব কমসংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা যাবে।
অবশ্য মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এ খাতের ৪২৫ কোটি টাকা অব্যয়িত ছিল। অর্থ বছর শেষ হলেও তা ট্রেজারিতে ফেরত না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুমতি নিয়ে এই টাকা নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য রেখে দেওয়া হয়। এবার সেই অর্থ এ বছরের বরাদ্দ ২৫০ কোটি টাকার সঙ্গে যোগ হবে। তাই এবার অন্তত ৬৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও খাতে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিক বাছাইয়ে মাধ্যমিক স্তরের (নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় শুধু) দুই হাজার ৩০০ প্রতিষ্ঠান ফিট লিস্টে এসেছে। তবে কলেজ পর্যায়ে কঠিন শর্ত আরোপ করায় তারা বিপাকে পড়েছে। প্রতি শ্রেণিতে কমপক্ষে ৪০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। আগে ২৫ শিক্ষার্থী পাস করলেই চলত, এখন তিন পাবলিক পরীক্ষায় তিন বছরে কমপক্ষে ৭৫ জনকে পাস করতে হবে। এসব শর্ত কলেজগুলোকে চাপে ফেলেছে।

হতাশ শিক্ষক নেতারা কী করেন : নিজেদের প্রতিষ্ঠান যোগ্য বিবেচিত হবে না জেনে আগেরবার তালিকা প্রকাশ স্থগিত রাখতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছিলেন গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলারসহ কয়েকজন। কিন্তু মন্ত্রী তা শোনেননি। পরে  আন্দোলনের ডাক দিলেও সাড়া মেলেনি। যারা এমপিওভুক্ত হয়েছেন তারা সংগঠনের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেন না। এরপর থেকে সংগঠনের বলতে গেলে অস্তিত্ব নেই। এরই মধ্যে আরেক ননএমপিও শিক্ষক আরেকটি সমিতি করেছেন। দুই সমিতিই এখন এমপিও করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা তুলছেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাবোর্ডের কিছু কর্মচারীও টাকা হাতাচ্ছে মর্মে খবর পাওয়া গেছে।  

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী সমিতির নেতা হাবিবুর বলেন, করোনার দুই বছর নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা না পেয়ে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা দুঃসহ দিনযাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি, নীতিমালা নয়, মানবিক বিবেচনায় এই মুজিববর্ষেই সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে এমপিওভুক্ত করে মানবেতর জীবনযাপন থেকে আমাদের মুক্তি দেওয়া হোক। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049519538879395