বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সাবেক স্বঘোষিত ভিসি অধ্যাপক আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেকের মতো তার দুই বন্ধু বর্তমান ভিসি ও ট্রেজারারের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ সামনে এসেছে। লুটপাটে ক্ষুদ্ধ সিন্ডিকেট সদস্য ও শিক্ষকরা এবার এশিয়ানের কর্তাব্যক্তিদের ৩৯ খাতে লুটপাটের তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, সাবেক ভিসির কাছ থেকে চারটি বিলাসবহুল গাড়ি ফিরিয়ে না এনে তারা নতুন করে কিনেছেন আরো দুটি গাড়ি। ভিসি অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চাকরি করছেন এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়েও। মাসিক ৫ লাখ টাকা বেতনের পাশাপাশি বছরে দুবার বিদেশ যাওয়ার টিকিটসহ নানা সুবিধা নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট থাকার পরও বাড়ি ভাড়া দেখিয়ে মাসে নেন আরো ৩০ হাজার টাকা। আর ট্রেজারার চুক্তিতে ৯০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করলেও তিন মাসের মাথায় তা বাড়িয়ে করেছেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, সাবেক ভিসি সাদেককে অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে চাকরি দেয়া হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বেতনে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যান্য অধ্যাপক ডিনদের বেতন ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এর আগে ইউজিসির তদন্তেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি সাদেকের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ইউজিসির তদন্তের আলোকে মন্ত্রণালয় বেশ কিছু নির্দেশনা দিলেও তা মানা হয়নি। এ ছাড়াও সাদেক পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এম. আনিছুর রহমান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ও কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মহসিন উদ্দীন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আসাদুজ্জামান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. একেএম মহিব্বুল্লাহ, বিজনেস এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেহেনা সুলতানা বিপাশা তাদের অভিযোগের পক্ষে তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বর্তমান ভিসি পদে প্রফেসর শাজাহান খান একই সঙ্গে দুই দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। এশিয়ানের ভিসি ছাড়াও তিনি অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ম্যাথমেটিকস ফিজিক্স এন্ড কম্পিউটিং এর পরিসংখ্যান বিভাগে পূর্ণকালীন প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। নিয়মিত তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে ক্লাস নেন। অস্ট্রেলিয়ার ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি কিংবা অবসর গ্রহণ ছাড়াই নতুন করে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভাইস-চ্যান্সেলর দায়িত্ব নেন। বেতন-ভাতা বাবত প্রতি মাসে নেন ৫ লাখ টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এস এম ইয়াসীন আলীর মালিকানাধীন আমার প্রোপার্টিজের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা মূল্যে ক্রয় করা দুটি ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও ভিসি শাহজাহান খান বাড়ি ভাড়া বাবদ নেন আরো ৩০ হাজার টাকা। আর ওই ফ্ল্যাট দুটির মাসিক ভাড়া যাচ্ছে সাবেক ভিসি সাদেকের পকেটে। সিন্ডিকেট সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কিভাবে ব্যবসা করেন। এমনকি ইয়াসিন আলী বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বাইরে বেআইনিভাবে সিন্ডিকেট সদস্য বলেও উল্লেখ করা হয়।
ইউজিসির তদন্তেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ভাতা কম থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রভাষক পর্যায়ের একজন শিক্ষকের বেতন ছিল মাত্র ১৩ হাজার টাকা, আর অধ্যাপক পর্যায়ে তা ছিল ১৯ হাজার থেকে ২৩ হাজার। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেতন বাড়িয়ে জাতীয় স্কেলের সমমান করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশও না মেনে ২০ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছে।
সাদেকের ব্যক্তিগত ড্রাইভার ইমাম হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারি দেখিয়ে বেতনভাতা বাবদ ২২ হাজার টাকা, নরসিংদীর পীরপুর সাদেক দাখিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল রফিকুল ইসলামকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারি দেখিয়ে ১৫ হাজার টাকা, নরসিংদীর পীরপুরে সাদেকের গ্রামের বাড়ির পাহারাদার রমজান মিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারি দেখিয়ে বেতনভাতা বাবদ মাসে ৮ হাজার টাকা, ট্রাস্টি সদস্য সালেহা সাদেকের গরুর খামার আশুলিয়ার কর্মচারি শফিকুল ইসলামকে কর্মচারি দেখিয়ে বেতনভাতা বাবদ মাসে ৮ হাজার টাকা, মামাতো ভাই সাদেকের ব্যক্তিগত সিকিউরিটি গার্ডকে ২২ হাজার টাকা, সাদেকের মতিঝিলের বাসার সিকিউরিটি গার্ড আবুল কালাম আজাদ, মশিউর রহমান, ঝাড়ুদার ইকবাল হোসেন, আঙ্গুর মিয়া, সাদেকের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান জাফর সাদেকের ব্যক্তিগত ড্রাইভার আব্দুল বারীকে বেতন দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে। এভাবে প্রতিমাসে ৫ লাখ টাকারও বেশি বেতনভাতা দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এছাড়া বিগত একযুগেও বাড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক-কর্মচারির বেতন। অথচ ট্রেজারার প্রফেসর নূরুল ইসলাম চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে যোগদানের তিন মাসের মাথায় নিজ বেতন ২০ হাজার টাকা বাড়িয়েছেন। ৯০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে এখন তার বেতন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। অভিযোগে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারির বেতাভাতা কিংবা অন্য কোন সুবিধা বৃদ্ধি করতে হলে রাষ্ট্রপতি দপ্তরের অনুমোদন নেয়া আবশ্যকীয়। কিন্তু ট্রেজারার প্রফেসর নূরুল ইসলামের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন অনুমোদন নেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া অভিযোগে ৫ সিনিয়র শিক্ষক বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাধ্যমে সার্টিফিকেট বাণিজ্য এখনো চলছে সীমাহীনভাবে। এ বিভাগের প্রধান ড. তাহমিনা আশরাফ ওরফে রিটা আশরাফের হাত দিয়ে হাজার হাজার সার্টিফিকেট চলে যাচ্ছে। সেমিস্টারে একজন শিক্ষকের সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৮ ক্রেডিট টিচিং অ্যাসাইনমেন্ট হয়, কিন্তু রিটা আশরাফ প্রতি সেমিস্টারে ৪৮ থেকে ৬০ ক্রেডিট পর্যন্ত টিচিং অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণ করেন। এর ফলে তিনি কোন ক্লাশ পরীক্ষা না নিয়ে টাকার বিনিময়ে রেজাল্ট জমা দেন।
অন্য বিভাগগুলোতেও চলছে নীরবে সার্টিফিকেট বাণিজ্য। এ পর্যন্ত কতগুলো সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে এবং তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যয় করা হয়েছে তা কেউ জানে না। অভিযোগে সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি সনদ বাণিজ্যের প্রমাণ তুলে ধরে অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও ১৮টি সেন্টারের মাধ্যমে সারাদেশে দূর শিক্ষণের নামে কয়েক লক্ষাধিক সার্টিফিকেট বিক্রি করা হয়েছে।
এ ছাড়াও করোনা মহামারির সুবিধাকে লুফে নিয়ে ড. সাদেক পরিবার সোমালিয়া-নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অনলাইনে শিক্ষার নামে বিপুল সংখ্যক সার্টিফিকেট দেয়ার চেষ্টা করছে। ডিজিটাল যুগে হাতের নাগালে ব্যাংকিং সুবিধা থাকলেও টিউশন ফিসহ অন্যান্য টাকা উত্তোলন করা হয় হাতে হাতে। এ ছাড়াও প্রতিমাসে শিক্ষক-কর্মচারির প্রভিডেন্ট ও কল্যাণ ফান্ডের নামে লাখ টাকা বেতন থেকে কেটে রাখলেও নেই তার হিসাবও।
বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহজাহান খান কোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক ভিসি ড. আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেকের ছেলে জাফর সাদেককে দফায় দফায় কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেরনি।
সাবেক ভিসি ড. আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেকের সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তিনি সৌদি আরব রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহেল রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রেজারার অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম বলেন, অভিযোগের বিষয়ে আমি কথা বলতে পারব না। আপনি রেজিস্ট্রার সাহেবকে কল করেন। তিনিই সব বলবেন।
রেজিস্ট্রার এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগের বিষয়ে আমি এখনো কিছু জানি না।
ইয়সিন আলী কোন ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট সদস্য- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি আসার পর থেকে দেখছি তিনি সিন্ডিকেট সদস্য। তবে কোন ক্যাটাগরিতে বা কিভাবে তা আমি জানি না।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকের স্ত্রী ও ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য সালেহা সাদেক বলেন, ইয়াসিন আলী সিন্ডিকেট সদস্য। তবে কোন ক্যাটাগরিতে তা বলতে পারছি না।
দৈনিক শিক্ষা ডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।