এসএসসি: শিক্ষকদের ভুলের মাশুল দিয়েই চলছে পরীক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ |

এসএসসি পরীক্ষায় এক শ্রেণির শিক্ষকের দুর্নীতির মনোভাব ও গাফিলতির কারণে বড় ধরনের মাশুল দিতে হচ্ছে পরীক্ষার্থীদের। বাজারে নিষিদ্ধ নোট-গাইড থেকে হুবহু তুলে দেয়া হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন, কেন্দ্রে নতুন  ও পুরনে সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নবিতরণে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। আবার কোথাও কোথাও ইচ্ছেমতো পরীক্ষার সময় বাড়াচ্ছেন বা কমাচ্ছেন তারা। এছাড়া পরীক্ষার হলে এমসিকিউ অংশের সমাধান সরবরাহ করার যে ধারা চালু করেছিলো ক্যামব্রিয়ান, মাইলস্টোন, সামশুল হক খান ও কাদের মোল্লাসহ কয়েকটি স্কুল ও কলেজ তা এখনও কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। তবে, ক্যামরিয়ান কিছুটা সাইজ হয়েছে। কারণ, তাদের শিক্ষার্থীদের আর নিজেদের মতো করে কেন্দ্র বা ভেন্যু কেন্দ্রে নিতে পারছেন না।  

আবার, বহিরাগতদের হাতে পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা হামলার শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। শত শত শিক্ষক সংগঠন থাকলেও শিক্ষকদের নিরাপত্তা বিধান নিয়ে কিছু বলছেন না। শুধু ফেসবুকে অশিক্ষকসুলভ আচরণ আর উসকানিমূলক বক্তব্য লিখে চলছেন।

এক সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় একাধিকবার পরীক্ষা স্থগিত বা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের এসে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে প্রশ্ন ফাঁস। কিন্তু এবার পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটির প্রমাণ মিলছে। আর মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র সচিবকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে।

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, ভর্তিসহ নানা পরীক্ষায় শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই গ্রেফতার হয় ১৯০ জন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এখনো বড়ো কোনো শাস্তির খবর পাওয়া যায়নি। ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার ঘটনা গত বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ছিল আরো ভয়াবহ। শতাধিক কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা বারবার ভুল করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। শুধু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কেন্দ্রসচিবকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।

ননপ্রোগ্রামাবল ক্যালকুলেটর ব্যবহার করার অনুমতি থাকলেও পরীক্ষা হলে এ সুযোগ দেওয়া হয়নি অনেক জায়গায়। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে পরীক্ষার্থীরা। ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে মাদারীপুরের শিবচরে একটি কেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় মাদারীপুরের শিবচরে কেন্দ্র সচিব ও সহকারী কেন্দ্র সচিবকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এসএসসির গণিত পরীক্ষায় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় নন্দকুমার মডেল ইনস্টিটিউশনে ক্যালকুলেটর নিয়ে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শেখ ফজিলাতুন্নেছা বিদ্যালয় কেন্দ্রেও কয়েকজনের কাছ থেকে ক্যালকুলেটর নিয়ে নেওয়া হয় বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। এর প্রতিবাদে বুধবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা শেষে নন্দ কুমার মডেল ইনস্টিটিউশনে ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দাখিল পরীক্ষার আসন বিন্যাসে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বোর্ডের নির্দেশনা আমলে নেওয়া হয়নি। আর্থিক সুবিধা নিয়ে আসন বণ্টন করা হয়েছে। এ ঘটনায় দাঁতমণ্ডল এরফানিয়া আলিম সিনিয়র মাদরাসা কেন্দ্রের সচিব ও নিরাপত্তাজনিত কারণে হল সুপারকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, আসন বিন্যাসকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনায় দাখিল পরীক্ষার এ কেন্দ্রটি নাসিরনগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় এসএসসি পরীক্ষায় নকলে সহযোগিতা না করায় সৈয়দাবাদ এএস মনিরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। এতে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ ৯ পরীক্ষার্থী আহত হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে উপজেলার গোপীনাথপুর শহিদ বাবুল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

গত মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি স্কুল কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ওই পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব পরীক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। হাবিবুর রহমান নামের একজন অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাকে জানান, মঙ্গলবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের গণিত পরীক্ষা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুলের পরীক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি স্কুল। কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ১৫ মিনিট বিলম্বে দেওয়া হয়।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে একাধিক কেন্দ্রে ছিল ভুল প্রশ্নপত্রের ছড়াছড়ি। প্রথমে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা শুরু করা হলেও বেশ কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীদের ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। তবে কিছু কেন্দ্রে সময় বাড়িয়ে দেওয়া হলেও কোথাও কোথাও সময়ও বাড়ানো হয়নি। 

এদিকে, জামালপুর শহরের ভোকেশনাল মোড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় পাওয়া চলতি এসএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথমপত্রের ৫০টি উত্তরপত্রের একটি বান্ডিল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জয়নাল আবেদীন নামে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক উত্তরপত্রের বান্ডিলটি পান। তার অটোরিকশায় ময়মনসিংহ থেকে আসা এক পুরুষ যাত্রী তা ফেলে গেছেন বলে তিনি পুলিশকে জানান। পরীক্ষার খাতার গুরুত্ব বুঝে জয়নাল আবেদীন খাতাগুলো ফেরত দিতে মালিক খুঁজতে থাকেন। মালিক না পেয়ে মঙ্গলবার রাতে জামালপুর সদর থানায় উত্তরপত্রগুলো জমা দিতে যান। পরে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে খবর পেয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. সামছুল ইসলাম বুধবার দুপুরে সদর থানায় এসে আরও একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে থানার ওসি মো. সালেমুজ্জামান তার হাতে উত্তরপত্রগুলো তুলে দেন।

ঢাকা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভুল প্রশ্ন বিতরণ থেকে রক্ষা পেতে আগামী এইচএসসি পরীক্ষা থেকে পুরোনো সিলেবাসের শিক্ষার্থীদের আলাদা 'ডিজিটাল রোল নম্বর' দেওয়া হবে। এতে তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে।

সএসসি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আরেক গালিফতি হলো ছাপায় ত্রুটি। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি অংশে পরের দিনের ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ের প্রশ্নপত্র ছাপা হয়।

এছাড়া নোট-গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়ার জন্য দায়ী শিক্ষকদের কোনও শাস্তি হয়েছে বলে জানা নেই। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন 'বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের' (বেডু) নামে বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয় প্রশিক্ষণের নামে। বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে কি শেখানো হলো শিক্ষকদের আর কি উন্নতি হলো তা জানার  কোনো উপায় নেই। কারণ, ওই ইউনিটের কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা নেই বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষকদের। 

 এ ইউনিট থেকে ট্রেনিং ম্যানুয়াল ছাপা হয়। প্রশিক্ষণে ডাকা হয়। কিন্তু প্রশ্ন তৈরি, মডারেশন, কেন্দ্র ইত্যাদি নির্ধারণের সময় স্বজনপ্রীতি বা টাকার বিনিময়ে সিদ্ধান্ত হওয়ায় প্রশিক্ষণ কোনো কাজে আসে না বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষকদের।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059068202972412