সেই পুরনো আপ্তবাক্য ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।’ কভিডের রক্তচক্ষুতে আমরাও ঘর পোড়া গরু ছিলাম। অনেক কিছুর মতো আমরাও চোখের সামনে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ পুড়তে দেখেছি। প্রায় দুই বছর পর কিছুটা স্বস্তির মুখ দেখেছি। কভিডের দাপট কমেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমেছে। মৃত্যু কোনো কোনো দিনে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ চলে এসেছে টিকার আওতায়। স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে দেশ। অফিস-আদালত, কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আর যানবাহন চলা স্বাভাবিক হয়ে যায়। বুধবার (১২ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রশ্নে সরকারকে আরেকটু ভাবতে হয়। এরপর ধাপে ধাপে খুলতে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা। এরই মধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সরাসরি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সীমিত পরিসরে খোলার পর পরিসর বড় হতে থাকে। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও ক্লাস পরীক্ষা শুরু হয়। হলের দরজাও খুলে যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই দুই ডোজ টিকা নিয়ে অনেকটা সুরক্ষিত। ফিরে আসতে থাকে ছন্দ। এমন এক বাস্তবতায় ওমিক্রনের আঘাত বাংলাদেশের ওপরও আছড়ে পড়ে। তবে বহির্বিশ্বের মতো অতটা সংক্রমণ ছড়ায়নি। মৃত্যুর হার খুব বাড়েনি। তবে সরকারসহ সবাইকে সতর্ক হতে হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে বড় প্রশ্ন এসে দেখা দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার বন্ধ করে দিতে হবে কি না।
এসব প্রশ্ন সামনে রেখে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী গত ৯ জানুয়ারি রবিবার কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁরা এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কথা ভাবছেন না। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন থেকে সতর্কতার সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তখন বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। বরং সরকার টিকা গ্রহণের পরিধি বৃদ্ধি করার কথা ভাবছে।
আমরা মনে করি, এটি সরকারের একটি মেধাবী সিদ্ধান্ত। আমরা পূর্বাপর পরিস্থিতি বিবেচনা না করে এবং প্রকৃত পরিস্থিতি বিচার না করে অতি আতঙ্কে অথবা দায় থেকে গা বাঁচাতে একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমরা মানি জীবন রক্ষার চেয়ে বড় দায় কিছু নেই। অনন্যোপায় হয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ পর্বে যেহেতু আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি, তাই আগেভাগে দরজায় খিল এঁটে ঘরে বসে থাকা কেন! যেখানে প্রজন্মের শিক্ষা, ভবিষ্যতের প্রশ্ন রয়েছে।
অনলাইন ব্যবস্থা স্বাভাবিক শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। এটি এক অর্থে জোড়াতালিই বলা যেতে পারে। স্কুল শিক্ষায় অ্যাসাইনমেন্ট কোনো সমাধান ছিল না। এটি ছিল ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা’র মতো কানা মামা। এভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে দুটি বছর ঝরে গেছে বলতে হবে। আমরা মাঝেমধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর মুখে অনলাইন পদ্ধতির শিক্ষার গুরুত্বের কথা বলতে শুনি। টিভি টক শোতে অনেক বিশেষজ্ঞের মতামতও তেমন দেখি। অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশও অফলাইন-অনলাইন পাশাপাশি চালাচ্ছে। এর উপকারও রয়েছে। এসব যৌক্তিক কথার পাশাপাশি বিবেচনা করা প্রয়োজন সেই সক্ষমতা আমাদের কতটুকু? সাধারণত আমরা জুমের মাধ্যমে স্কুল শিক্ষা পরিচালনা করছি। জুম প্রধানত মিটিং বা সেমিনার করার উপযোগী মাধ্যম। শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনেক সিস্টেম এখানে নেই। অনেকে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরেকটু কার্যকর গুগল ক্লাসরুম বা মিট লিংকের মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এখানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া, নানা ম্যাটেরিয়াল দেওয়া, পরীক্ষার উত্তরপত্র জমা নেওয়া ইত্যাদি ব্যবস্থা রয়েছে। এর চেয়েও আরো স্মার্ট পদ্ধতি ক্যানভাস। এখানে মিট লিংকের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া, ক্যানভাসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সেট করে দেওয়া, নির্ধারিত দিন ও পরীক্ষার সময়ে শিক্ষার্থীদের সামনে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাওয়া, বেঁধে দেওয়া শেষ সময়ের মধ্যে উত্তরপত্র জমা দেওয়া, কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট আর নানা ম্যাটেরিয়াল জমা দেওয়া, পরীক্ষার সময় প্রক্টরিংয়ের সুবিধার জন্য ক্যামেরা খোলা রাখা ইত্যাদি ব্যবস্থা থাকছে ক্যানভাসে। এসব ব্যবহার করে উন্নত বিশ্বে আগে থেকেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে তা সরাসরি ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হিসেবে নয়। ক্লাসরুম শিক্ষার পর প্রধানত পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদি কাজ পরিচালনা করা হয় অনলাইন মাধ্যমে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় যেখানে জুমেও নেট ও বিদ্যুৎ সংকটে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সব সময় ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। বিদ্যুত্সংকট তো হরহামেশা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কয়টি পরিবারের সামর্থ্য রয়েছে মোবাইল ডাটা কিনে প্রতিদিন ক্লাস করার। আর ক্যানভাসের মতো আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণই বা কোথায়!
চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ক্লাস করতে গিয়ে মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে গিয়ে শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের চোখসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মানসিক বৈকল্যও দেখা দিচ্ছে। অনেক শিক্ষক অনলাইন শিক্ষায় যুক্ত থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। এসব কারণে শিক্ষাদানের স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হচ্ছে। এমন এক বাস্তবতায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটি কোনো ধোঁয়াটে সিদ্ধান্তে যায়নি বলে আমরা স্বস্তি প্রকাশ করছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে টিকা গ্রহণের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।
এখানে একটি বড় প্রশ্ন আমাদের সামনে রয়েছে। তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অফলাইন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের প্রশ্ন আসার কথা সবার পরে। কারণ এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশির ভাগই টিকার আওতায় এসেছে। তাই ওমিক্রন বা কভিডে কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন আবার সুস্থও হয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের ইস্যু সামনে দাঁড় করিয়ে হুট করে অফলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়াটা শিক্ষা পরিস্থিতিকে আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়ার নামান্তর হবে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই রাজনৈতিক ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়ার পর নতজানু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দৃঢ়চেতা পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালক আর তেমন পাচ্ছে না, যাঁরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রথম ভাববেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন বানাতে চাইবেন। এর বদলে নিজেদের ভালো রাখা ও ভালো থাকাই তাঁদের জন্য প্রধান। ছাত্র-শিক্ষক বিক্ষোভ আতঙ্ক তাঁদের সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই কোনো ছুতা পেলে এই ধারার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালকরা অদ্ভুত ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়ায় তৈরি সিন্ডিকেট বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে উদগ্রীব থাকেন। অথবা শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে দূরে রেখে স্বস্তি পেতে চান। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তা ভাবার অবকাশ তাঁদের নেই। এই ধারায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগিয়ে থাকে। এখনো আমার জানা মতে, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিকভাবে অফলাইন-অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চলছে। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে অফলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারি সিদ্ধান্ত জানার জন্যও অপেক্ষা করেনি। আমরা মানছি আগামীকালও যদি পরিস্থিতির অবনতি হয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কভিডবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অনলাইনের শিক্ষায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে পথেই হাঁটতে হবে। কিন্তু যেখানে স্বাভাবিক ছন্দে ক্লাস-পরীক্ষা চলছিল, গবেষণা-সেমিনারগুলো হচ্ছিল, সেখানে কেন বাস্তবতা বিবেচনা না করে ক্যাম্পাস অস্বাভাবিক করে ফেলা হলো, ক্ষতিগ্রস্ত হলো স্বাভাবিক শিক্ষার ছন্দ, তা আমাদের বোধগম্য হলো না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন প্রধানত শিক্ষার্থী আর গবেষকরা।
আমরা তো দেখেছি গত দুই বছরের বন্ধ্যত্বে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের শিক্ষকদেরই তো অভিভাবক হিসেবে এসব বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষার পরিবেশ সচল রাখার কথা। একটি যুক্তি আমার কাছে স্পষ্ট নয়, নিকট অতীতেও দেখেছি হল ও অফলাইন ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলে অনেক শিক্ষার্থী মেস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে থাকে। অনেকে বাড়িতে চলে যায়। সেখানে তারা পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। নিজেদের পক্ষে যতটা স্বাস্থ্যবিধি মানা দরকার, তা মানার চেষ্টা করে। তাহলে ক্যাম্পাসগুলো কি সংক্রমণের আখড়ায় পরিণত হয়েছে? এখানেই কি শুধু কভিড ওত পেতে আছে? আমরা তো এবার অফলাইনে আসার পর মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীরা সেভাবেই ক্লাসে আসত। ক্যাম্পাসেও মাস্ক পরার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের নতুন করে শুরু হওয়া স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন ব্যাহত করা অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। প্রশাসন নিরুদ্বেগে থাকার জন্য শিক্ষার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে।
আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, কভিড বা ওমিক্রন ভয়ংকরভাবে জাঁকিয়ে না বসুক এ দেশে। এ জন্য দেশবাসীকেই সতর্ক থাকতে হবে। মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মান্য করলে আমরা স্বাভাবিক জীবন ছন্দকে আর হারাব না। যতক্ষণ পর্যন্ত সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যাবে বা আশঙ্কা তৈরি না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা খোলা থাক—এই আবেদন থাকবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে।
লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়