কন্যা শিশুর শিক্ষার অন্তরায়

গুরুদাস ঢালী |

আমি আজ কোনো বিচার চাইতে আসিনি। সুবিচারেরও আশা করি না । শুধু জানতে চাই, এ অবক্ষয়ের শেষ কোথায়! বই মেলায় উপচে পড়া ভিড় দেখে মনে হয় এ জাতি কত বই প্রিয়। জানতাম বা শুনতাম বই পড়লে নাকি মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় । কিন্তু বিবেক জাগ্রত হওয়ার বদলে দেখি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।

আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যত । শিশুর ভবিষ্যত কে সুনিপুণ ভাবে তৈরি করতে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। আর এই পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব আপনার আমার সকলের। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব আর কর্তব্য আজ প্রশ্নবিদ্ধ। রুচির দুর্ভিক্ষের এই যুগে সত্যিই কি আমরা হেরে যাবো ? শিশুকে তার বেড়ে উঠার পরিবেশ কি বার বার কলংকিত হবে। হায়েনার আঘাতে কি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হবে শিশুর স্বপ্ন। 

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইভেট কোচিং-র প্রভাব অতিবেশি। সেটা হোক কারিকুলাম বা ভালো ফলাফলের অতি উৎসাহী অভিভাবক। শিশুর মতামত কে উপেক্ষা করে সকাল বিকাল চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যা শিশুর মানসিক নির্যাতনের সামিল। প্রাইভেট কোচিং তো কোনো শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়, শুধু শিক্ষার অনুসঙ্গ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেখানে জিপিএ বিক্রি হয়। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি, যে এগুলোও কোচিং সেন্টারের আদলে বেসরকারি ব্যবসায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান -নতুন বোতলে পুরানো মদ। এখানেই তৈরি হয় মুরাদ পরিমলরা। আর সহযোগিতা করে ফৌজিয়াদের মতো প্রতিষ্ঠান প্রধান রা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা করে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসার কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। এমনকি শিক্ষকরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারেও পড়াতে পারবেন না। তবে দিনে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। আর সরকার নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতরই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস করানো যাবে। এ জন্য কাউকে বাধ্য করা যাবে না। তবে কাগজে এই নীতিমালা থাকলেও সারা দেশের বহু শিক্ষক নীতিমালা উপেক্ষা করে প্রাইভেট ও কোচিংয়ে পড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে কোনো তদারকিও দেখা যায় না। তদারকিটা করবে কে ? তদারকি করা লোকের বড় অভাব । সত্যি যদি তদারকির কোনো চিহ্ন থাকতো তাহলে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল কন্যা শিশু নির্যাতনের আখড়ায় পরিণত হতো না।

আগে শিক্ষার্থীরা সাধারণত ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে প্রাইভেট পড়তো বা কোচিং করতো। শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী কোচিং সেন্টার বা যার যার পছন্দের জায়গায় পড়তো। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের হাতেই বেশিরভাগ নম্বর থাকায় শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে চার-পাঁচটি বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে। অনেক শিক্ষক আবার প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করছেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা আরো বেশি ঘটছে । নতুন কারিকুলাম অনেক অভিভাবক বুঝতে পারছেন না। এই সুযোগে অনেক শিক্ষক নানাভাবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে কোচিং-টিউশনির ফাঁদে ফেলছেন। যৌন নির্যাতনের সেল তৈরি করছেন।

দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ কন্যা শিশু , যারা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করেন এর্ং যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। শিক্ষার সব স্তরে নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ক্ষেত্র বিশেষে যার পরিণাম দাঁড়াচ্ছে আত্মহনন। এসব ঘটনা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা কী করে আমাদের মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের একটি নিরাপদ এবং সুন্দর পরিবেশ দিতে পারি। বিশেষত সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোয়, যেখানকার শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮–এর নিচে। এ বয়সের শিক্ষার্থীরা অনেক সময় সংকোচ এবং ভয়ে অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারেন না, পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট মানসিক পরিপক্বতা তাদের থাকে না এবং কী করা উচিত বা কী করতে হবে, তারা তা  বুঝে উঠতে পারেন না। আর এর সুবিধা নিয়ে থাকে নির্যাতনকারীরা । ভুক্তভোগীরা এই ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ায় জীবনভর। তখনই মনে হয়, জন্মই যেনো আজন্ম পাপ। 

ভিকারুননিসা নূন স্কুলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনার পর এ ঘটনার তদন্তে  একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে বলেও ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত না করে আজিমপুর শাখা থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকার বেইলি রোডের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এটা কিভাবে সম্ভব । তাহলে কি আমরা অভিযোগ কে আমলে নিচ্ছি না, নাকি এটা একেবারে স্বাভবিক বিষয়।

তৃতীয় দফায় পেছালো অরিত্রীর আত্মহত্যা মামলার রায়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে- এমন অভিযোগে অরিত্রীর মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। অধ্যক্ষের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরে বাসায় যেয়ে দেখা যায়, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় ঝুলছে। এই আত্মহননের দায় কার ! ‘Justice delayed is justice denied’ কথাটি তাহলে সত্যি হতে যাচ্ছে। রায় প্রস্তুত না হওয়ায় কারণে আর কত অরিত্রীর আত্মহননের বিচার থেকে মুখ ফিরিযে নিতে হবে। তবে কি নির্যাতন চলতেই থাকবে? আর কত আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখে যেতে হবে!

নারী দিবস, কন্যা শিশু দিবস পালন করে কি হবে। যে দেশে শিশুর ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারটুকু টুঁটি চেপে হরণ করা হয়। নারী শিশুর সম্ভ্রম নিয়ে শেয়াল কুকুরের মতো টানাটানি হয়! সেখানে নারী দিবস, কন্যা শিশু দিবস কী বার্তা দিতে পারে। আমরা অনেকেই নারী জাগরণের কথা বলি কিন্তু নারীর জাগরণের পথ যদি রুদ্ধ করে রাখি তাহলে কি জাগরণ হবে?

আমাদের কন্যা শিশুর বিকাশ ও বেড়ে ওঠার সঠিক পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। গুটি কয়েক লোকের হাতে আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট হতে দেয়া যাবেনা। সন্তানের পাশপাশি অভিভাবককেও সচেতন হতে হবে। অভিযোগ পাওয়া মাত্র আইনের দারস্থ হতে হবে। কোনো সমঝোতায় নিজেকে বেঁধে রাখা যাবে না। তবে সরকার ও রাষ্ট্রকে কিছু নিয়মের পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতনে সহনশীলতার কোনো সুযোগ নেই বিষয়টি উল্লেখ করা। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে মনিটরিং টীম  গঠন করা এবং হট লাইন নম্বর যোগ করা, যাতে অভিযুক্ত নারী ও শিশু  সহজে তার সমস্যার কথা জানাতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ক বিচারিক কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা। দোষী ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা যাতে আর কেউ যেনো এমন কাজ করা বা সহযোগিতার সাহস না পায়।  

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সংসদে, শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যৌন নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতা শিকার করে নাগরিকদের কাছে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ক্ষমা চায় অস্ট্রেলিয়া। হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভের গ্রেট হলে এদিন জড়ো হয়েছিলেন আট শতাধিক মানুষ৷ তাদের সামনে দাঁড়িয়েই সারা বিশ্বের জন্য অনন্য এই ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেন অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতারা ৷ এদিন বিরোধীদলীয় নেতাও একইভাবে নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন৷

আমরা এ রকমটা করতে পারবোনা বলা যাবে না, রাষ্ট্র চাইলে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে, যৌন নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু ও নারীদের জন্য জাগরণের নবচেতনা সূচিত হবে বলে সবার বিশ্বাস ।

লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026850700378418