কপোতাক্ষ নদের তীরে স্থাপিত হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কপোতাক্ষ অববাহিকা বিস্তৃত বিশাল এলাকাজুড়ে। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা এমনকি কুষ্টিয়ার অংশবিশেষ এ অববাহিকা প্রভাবিত এলাকা; যার আয়তন প্রায় ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।

কপোতাক্ষ অববাহিকার সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এ এলাকাটি অনেকটা ত্রিভুজ আকৃতির, যার কেন্দ্রে রয়েছে সাগরদাঁড়ি। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাগরদাঁড়ি গ্রাম। বস্তুত মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কপোতাক্ষ নদ ও সাগরদাঁড়ির পরিচিতি দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যাতায়াত ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে অববাহিকার এ অঞ্চলটিতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি ও অন্য দিকগুলো বিকশিত হতে পারেনি। সাগরদাঁড়ির ভৌগোলিক অবস্থান এমন এক স্থানে, যেখান থেকে কমবেশি খুলনার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার, যশোরের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার, এমনকি সাতক্ষীরা জেলা শহরের দূরত্বও ৪০ কিলোমিটার। এমন একটি অবস্থানের কারণে প্রত্যন্ত এলাকা হিসাবে সাগরদাঁড়ি আজও অবহেলিত। নদীর ওপারের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও খারাপ।

এলাকার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতা থাকার কারণে আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়; বিশেষ করে কপোতাক্ষ ভরাট হওয়ার ফলে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অথচ ১৯৮০-৮৫ সাল পর্যন্ত এ নদে লঞ্চ চলেছে। এরও ২৫-৩০ বছর আগে এ নদে স্টিমারও চলেছে। এক সময় এ অববাহিকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য (শাক-সবজি, ফলমূল) এবং মাছ, খাসি, মুরগি, ডিমসহ বেশকিছু পণ্য ছিল কলকাতার বাজারের অন্যতম আকর্ষণ।

কেশবপুর, তালা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, মনিরামপুর, কলোরোয়ার ডাব, নারিকেল, আম, কাঁঠাল এবং কৃষিজাত কুটির শিল্পের পণ্যের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। এসব পণ্য বড় বড় নৌকায় (গয়নার নৌকা) করে নিয়ে যাওয়া হতো কলকাতায়। এ অঞ্চলের নৌকা কলকাতার বাজার কালিঘাটে ভিড়লেই আড়তদার বা পাইকাররা ছুটে আসতেন। এর প্রধান কারণ, কপোতাক্ষ অববাহিকার পানিতে ছিল না লবণাক্ততা। তখন কপোতাক্ষে প্রবাহ ছিল এবং লোনা পানি উপরে আসতে পারত না।

ফলে তালা, কেশবপুর, মনিরামপুর, কলারোয়ার শাক-সবজির স্বাদ ছিল আলাদা। একইসঙ্গে পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগরের উপকূলীয় নানা প্রজাতির মাছও যেত কলকাতায়। এখন এসবই ইতিহাসের কথা। এরপর কপোতাক্ষের পলি ভরাট হলে এলাকায় জলাবদ্ধতার অভিশাপ নামে। দুই দশকেরও বেশি সময়ের জলাবদ্ধতায় আর লবণ পানির প্রবেশে সে ঐতিহ্য হারিয়ে যায়। পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর পড়ে এর বিরূপ প্রভাব।

তবে দুবছর আগে কপোতাক্ষ নদ খনন করা হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতা সমস্যা অনেকটা কমেছে। কিন্তু কপোতাক্ষ এখন খালে পরিণত হয়েছে এবং তা ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্য হারিয়েছে। দুই পারের অব্যবহৃত খালি জমি ক্রমেই বেদখল হয়ে যাচ্ছে। স্থায়ীভাবে গড়ে উঠছে অবকাঠামো।

এ অবস্থায় এই অঞ্চলের প্রাণ ফিরে আসতে পারে মাত্র কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করলে : ১. কপোতাক্ষ নদীর তীরে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়িতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ২. কপোতাক্ষ নদকে পূর্ণমাত্রায় খনন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে কয়রা থেকে উজানে চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়ার মাথাভাঙার সঙ্গে সংযোগ সাধন, ৩. বর্ষাকাল এবং এর পরবর্তী দুমাস মিলিয়ে চার মাস পদ্মা ও গড়াইয়ের মিষ্টি পানির প্রবাহ ভাটিতে নিয়ে যাওয়া, ৪. কপোতাক্ষ নদের দুই তীর দিয়ে পরিকল্পিতভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং নদের এপার-ওপার সংযোগ সাধনে একাধিক ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ।

সাগরদাঁড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী তিনটি জেলা শহরই যেহেতু ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, সেহেতু এ ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতির স্মারক হিসাবে এবং পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখা দরকার।

সাগরদাঁড়িতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এলাকাটি উচ্চশিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। পাবনার শাহাজাদপুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য এলাকায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি দেশের জেলা শহরের বাইরে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।

এ বিবেচনায় মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়িতে কপোতাক্ষ নদের নামে কপোতাক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বা মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামে মাইকেল মধুসূদন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সাগরদাঁড়ি বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিস্তৃতি ঘটবে, সেই সঙ্গে কপোতাক্ষ নদকে দ্বিতীয় দফায় আরও প্রশস্তভাবে খনন করে নতুন এক আর্থ-সামাজিক প্রাণচাঞ্চল্যের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব হবে।

কপোতাক্ষের দুই তীরে পরিকল্পিতভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারলে বিস্তীর্ণ এ এলাকায় ধান, গম, ভুট্টাসহ খাদ্যশস্য, তেল বীজ, শাকসবজি ও ফলমূলের বাৎসরিক উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে গবাদিপশু ও মাছের উৎপাদনও ২৫-৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।

এ ছাড়া বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটতে পারে। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান এবং কপোতাক্ষ নদ এদেশের মানুষের মানসপটে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে নদ-নদী নিয়ে যত কবিতা রচিত হয়েছে, তার মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে পাঠক বিচারে কালোত্তীর্ণ।

তাই সাগরদাঁড়িতে এলে বা কপোতাক্ষ নদের তীরে গেলে আপনা থেকেই পথিক বা পর্যটকের হৃদয় থেকে উত্থিত হয় সেই শ্রেষ্ঠ কবিতার কয়েকটি চরণ : ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে/সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে।’/...বহুদেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে/দুগ্ধস্রোতরূপী তুমি মাতৃভূমি স্তনে।’ বিদেশি সাহিত্যে মগ্ন থেকেও কবি মুহূর্তের জন্য ভোলেননি বাংলার জল-মাটি-আকাশ-মানুষকে। আমৃত্যু তার স্মৃতিতে ছিল যশোরের সাগরদাঁড়ি, কপোতাক্ষ নদ। নিজের সমাধিফলকে তাই আহ্বান করেছেন বাঙালিকে। বলেছেন, ‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’

কপোতাক্ষকে ঘিরে তৈরি হোক সংস্কৃতির বলয়। এর তীরে স্থাপিত হোক একটি সাধারণ অথবা সাংস্কৃতিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে উঠুক সাংস্কৃতিক ও পর্যটন কেন্দ্র। বদলে যাক যোগাযোগ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা। কপোতাক্ষ অববাহিকার এ প্রত্যন্ত এলাকাটিকে নিয়ে এমনটিই প্রত্যাশা ও দাবি এ অঞ্চলের মানুষের।

লেখক : এস এম আতিয়ার রহমান, পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043680667877197