করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা এখনই প্রস্তুত করা প্রয়োজন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে কোভিড-১৯ মহামারি বৃহত্তম একটা ধাক্কা, যা বিশ্বের সব মহাদেশের ১৯০টিরও বেশি দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধের মাধ্যমে ১০৭ কোটি শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করেছে। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যেহেতু বিশ্ব জুড়ে লোকেরা তাদের ও তাদের পরিবারের করোনা ভাইরাস রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করে চলেছেন সেহেতু পরিবারের শিশুরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থেকে একটি সন্তোষজনক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সকলের সহায়ক পরিবেশে শিক্ষা নিতে পারে সেই ব্যবস্থাই প্রয়োজন আমাদের। বুধবার (২ জুন) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, একটি প্রজন্মের বিপর্যয় এড়াতে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে অগ্রাধিকার দেওয়া এখন সময়ের দাবি। সময়ের দাবি মানে আমরা এর প্রয়োজনয়িতা গভীরভাবে উলব্ধি করছি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে ধরে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নাই। এটা অনস্বীকার্য যে বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে যাওয়া হ্রাসে সরকারের শিক্ষাবৃত্তিগুলি অবশ্যই বড় অবদান রেখে চলেছে।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

ডিজিটাল মাধ্যমগুলি কোনো না কোনোভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যোগাযোগব্যবস্থাটা ধরে রেখেছে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শতকরা কত জন শিক্ষার্থীকে এই সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে তা নিবিড়ভাবে অনুধাবন করে সে মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। কারণ তারাও কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করছে। অনেকের জন্য সনাতন পদ্ধতির শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়া তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজন। পাঠদান এবং শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাতে প্রযুক্তি দ্রুত গ্রহণ করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং এটি অবশ্যই ঐতিহ্যগত বাঁধাধরা ভাবনার বাইরে সাংগঠনিক দক্ষতার একটি স্বাক্ষর।

তবুও এই পরিবর্তনটি (দূরবর্তী শিক্ষা বা দূরশিক্ষণ) চিত্তাকর্ষক হলেও ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতার জন্য প্রতিস্থাপন হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। কোভিডের চিরস্থায়ী প্রভাবগুলি কী হবে এবং এর পরবর্তী যুগে শিক্ষার চেহারা কেমন হতে পারে তা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করা প্রয়োজন। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে রাষ্ট্রের অন্যান্য তাত্ক্ষণিক অর্থ উত্পাদন খাতগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে যে খাতগুলি, যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এটা করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি আমলে নেওয়া প্রয়োজন বলে আমার বিশ্বাস।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো জোরদার করার নিমিত্তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষাই আমাদের যৌক্তিকভাবে অনুভূত করাবে এবং শেখাবে যে আমি তখনই নিরাপদ যখন আমরা সবাই নিরাপদ, আমি তখনই উন্নত হব যখন সবাই উন্নত হবে।

শিক্ষার অন্তর্নিহিত গুরুত্বকে আমাদের অনুধাবন করতে হবে, যাতে এটি তথ্যের সহজলভ্যতাকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। সমাজের সব বয়সের, সব স্তরের শিক্ষানবিশদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা অধিকারের গুরুত্বকে আরো প্রসারিত করা সম্ভব হবে।

শিক্ষকতা পেশা ও শিক্ষকদের সাহায্য-সহযোগিতার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। যে সমাজের চোখে যতদিন একজন আদর্শ শিক্ষক মানে ছেঁড়া পাঞ্জাবি আর লুঙ্গির সঙ্গে হাতে তালি দেওয়া ছাতা থাকবে, সে সমাজের অবস্থাও জোড়াতালি দেওয়াই থেকে যাবে, উন্নতির কাঙ্ক্ষিত জায়গায় কখনোই পৌঁছুতে পারবে না।

অতিমারির সময় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকরা নিজেদের তৈরি করেছেন। যুগোপযোগী ডিজিটাল পদ্ধতিগত দিকগুলি আত্মস্থ করেছেন। সম্মুখসারির শিক্ষাবিদদের স্বাধীনভাবে সহযোগিতামূলক কাজে বেশি বেশি উত্সাহ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে চিন্তাচেতনা দিয়ে শিক্ষা দান করতে পারে।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে উন্নয়ন বর্ধিত করতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধগুলো রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সনাতন শ্রেণিকক্ষের কোনো বিকল্প নেই যেখানে সে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে তার শিক্ষাগুরু এবং সহপাঠীদের সঙ্গে নিজেদের চিন্তাগুলো খোলামেলাভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ভাগ করতে পারবে।

যেহেতু করোনা আমাদের মধ্য থেকে একবারে চলে যাচ্ছে না, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্বাস অর্জন করাটা জরুরি। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর সপ্তাহে অন্ততপক্ষে একবার রেপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করা খুবই প্রয়োজন এবং এর সঙ্গে অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে পারলে আরো ভালো হবে। আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে মানসম্মত আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে হবে।

পাঠদানের প্রযুক্তিগত উত্স ও ডিজিটাল ডিভাইসগুলিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে উপলব্ধ করতে হবে। ডিজিটাল সংযোগের বাধা দূর করতে হবে। তবে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির বাইরে প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দিয়ে শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করা যাবে না। শিক্ষা কখনোই কিছু প্রাইভেট কোম্পানির তৈরি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের ওপর নির্ভর করতে পারে না, ঠিক তেমনি টিকতেও পারে না।

করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব। পাঠ্যক্রমের মধ্যে বৈজ্ঞানিক স্বাক্ষরতার বিষয়টি নিশ্চিত করার এটাই হলো সঠিক সময়।

নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবাইকেই বুঝতে হবে, শিক্ষা একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ থেকে রাতারাতি লাভবান হবার সুযোগ পৃথিবীর কোনো ফর্মুলাতেই নেই। এর জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ধৈর্যশীল জাতিই টেকসই উন্নতি করেছে। ভারত মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি-এর) ৩.১ শতাংশ (২০১৯), পাকিস্তান ২.৯ শতাংশ (২০১৭), ভিয়েতনাম ৪.৩ শতাংশ (২০১৬), ভুটান ৬.৬ শতাংশ (২০১৮) শিক্ষায় খরচ করেছে। অথচ আমাদের দেশে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ এই খাতে খরচ হচ্ছে, যা মিয়ানমারের বরাদ্দ থেকেও কম। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ যুগোপযোগী করতে হবে।

মহামারি কয়েক দশকের অগ্রযাত্রাকে গ্রাস করার বা ক্ষতিগ্রস্ত করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সব শিক্ষা উন্নয়ন অংশীদারদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে হলে শিক্ষা এবং শিক্ষার অর্থায়নকে সুরক্ষিত করতে হবে। এক্ষেত্রে করোনা মোকাবিলায় গতবার যেমন স্বাস্থ্য খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, শিক্ষা খাতেও এরকম সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোভিড-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা সামনের দিকে পরিচালনা করতে হবে। শক্তিশালী নেতৃত্ব ও সমন্বয়, পুনরায় শিক্ষাব্যবস্থা পরিকল্পনা, কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ ও অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ পুরোপুরি গ্রহণ করা উচিত।

জরুরি সময়ে গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হলো ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এ সময়ে সহপাঠী ও শিক্ষকদের যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে অথবা অত্যন্ত খণ্ডিতভাবে যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপিত হচ্ছে, যা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাটাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পাঠ্যক্রমের অগ্রগতিতে ছেদের কারণে শীক্ষার্থীদের বাকি শিক্ষাজীবনের অর্জনকে ব্যাহত করতে পারে। মূল্যায়ন পদ্ধতিগুলি প্রতিনিধিত্বমূলক করতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা, স্বনির্ভরতা, প্রাণোচ্ছলতা হারিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, কোভিডের বর্তমান ও পরবর্তী সময়ে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার বিষয়টি নজরে রাখা অপরিহার্য। তাই দীর্ঘমেয়াদি খারাপ প্রভাবের আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে কোভিড-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা এখনই প্রস্তুত করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলির ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের উদ্যোগ গ্রহণ করবে—এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: ড. এ এইচ এম নুরুন নবী,অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025398731231689