করোনাকালে বই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হোক

মাছুম বিল্লাহ |

শিক্ষার্থী মূল্যায়ন  একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া যা শিখন-শেখানো বিষয়ের অবিচেছদ্য অংশ। করোনা পরিস্থিতির কারণে মূল শিখন-শেখানো কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত, তারপরেও বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষাদান চলছে যেটি সর্বত্র সমানভাবে পরিচালনা কর সম্ভব হচেছনা। কিন্তু শিক্ষার্থী মূল্যায়নের উপায় কি।   শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হচেছ নতুন উপায়ে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করতে। শিক্ষার্থী মুল্যায়ন শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহন পদ্ধতিকে  সমালোচনামূলক করে তোলে এবং ভবিষ্যতে কিভাবে শিক্ষাদান  করা হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। আমরা সাধারণত শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পর তাদের মূল্যায়ন করে থাকি এমন উপায়ে, যাতে শিক্ষার্থীদের বই , নোট কিংবা অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ তাদের কাছে থাকেনা। যাকে আমরা বলি ‘বই বন্ধ করে পরীক্ষা নেওয়া’। যেখানে শিক্ষকগরা পরীক্ষা তদারকি করে থাকেন।

কিন্তু কভিডকালীন কি হবে? এই সময়ে বই উন্মুক্ত রেখে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারে। বই এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ সামনে   নিয়ে শিক্ষার্থী দিতে পারে।  এ ধরনের পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচেছ বুদ্ধিবৃত্তিক, কারণগত বিষয় এবং সৃজনশীলতাকে উস্কে দেওয়া আর তথ্য স্মরণ রাখাকে নিরুৎসাহিত করা। এটি করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যে বিভিন্ন বই ও উৎস থেকে উত্তর খোঁজে, পড়াশুনা করে, আলোচনা করে তাতে তাদের ধারণাসমূহ একটির সাথে আর একটি মেলানো ও তুলনা করার সুযোগ হয় , ফলে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, জ্ঞানের পরিসীমা বিস্তৃত হয়, রিজনিং ফ্যাকাল্টি ধারালো হয়। এছাড়াও  শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি দূর হয়, উদ্বেগ দূর হয়, মানসিক চাপ কমে। এগুলোর উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ভাল করার এবং জানা বিষয় ভুল করাকে  প্রভাবিত করে। ‘উন্মুক্ত বই পরীক্ষা’ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের  বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করে।এটি এখন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভারতের বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে। উন্নত বিশ্ব তো অনেক আগে থেকেই এ ধরনের পরীক্ষা প্রচলন রয়েছে। এমনকি আমাদের  দেশের কিছু কিছু সৃজনশীল ও ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষকগনও তাদের শ্রেণিকক্ষে বিষয়টি ব্যবহার করেন। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমরা যখন অনার্সে  টিউটরিয়েলগুলো দিতাম, আমাদের একজন ম্যাডাম ( তাহমিনা ম্যাডাম-বর্তামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচেছন) এক পরীক্ষা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আমাদেরকে আগেই  জানিয়েছিলেন, তোমরা বই সামনে খুলে রেখে পরীক্ষা দেবে। আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিই তিনি একদিন তাই করলেন । তিনি আমাদের রোমান্টিক কবি শেলী  পড়াতেন। কবিতার কোথায় প্লেটেনিক লাভ আছে, কোথায় কোথায় রোমান্টিক এলিমেন্ট আছে ইত্যাদি বের করতে বলেছিলেন। আমরা সেই নতুন ধরনের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যারা বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছিলেন তারা ভাল নম্বরই পেয়েছিলেন, বাকীদের একটু সমস্যা হয়েছিল।

উন্মুক্ত পরীক্ষা পদ্ধতিতে  শিক্ষার্থীরা বাসায় বই নিয়ে যেতে পারে কিংবা বাসায় বসে পরীক্ষা দিতে পারে। মুখস্থবিদ্যা পরীক্ষার চেয়ে বেশি কিছু পরীক্ষা করা যায় এই পদ্ধতিতে। এটি শিক্ষার্থীদের দ্রুত কোন তথ্য বের করার দক্ষতা এবং বুঝতে পারা, বিশ্লেষণ করার দক্ষতা এবং অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করার দক্ষতা পরীক্ষা করতে সহায়তা করে। শিক্ষার্থীদের সূক্ষ চিন্তন দক্ষতাও পরীক্ষা করা যায় এ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে বই থেকে শুধু মাত্র তথ্যের নকল নয়। এখানে শুধু উত্তর বের করাটাই ক্রেডিট নয় বা বেশি নম্বর পাওয়ার বিষয় নয়। বরং কিভাবে তারা তথ্যটি খুঁজছে, কিভাবে অ্যাপ্লাই করছে ,কিভাবে বিশ্লেষণ করছে এবং তথ্য ব্যবহার করছে সেগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্মুক্ত বই নিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের করা নোট, শিক্ষকের নোট, পাঠ্যবই এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ নিয়ে পরীক্ষায় বসতে হয়। এটি অবশ্য আইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে অজানা নয়, এখানকার পরীক্ষাগুলো সাধারনত এভাবেই হয়ে থাকে। কিন্তু অন্যান্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি অসাধারণ ও অপ্রচলিত এবং অজানা একটি বিষয়। তবে, কিছু কিছু সৃজনশীল শিক্ষক অনেক ধরনের টেকনিক অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করতেন যার উদাহরণ প্রথম প্যারাতেই দিয়েছি। সাধারণত আমাদের শিক্ষকরা যে ভুমিাক পালন করেন তা  হচেছ তথ্যের পরিবহন, পাঠ্যবইয়ের তথ্য শিক্ষার্থীদের মনে ঢোকানো। আর শিক্ষার্থীর কাজ হচেছ সেই তথ্য বুঝা, ধরে রাখা এবং পরীক্ষার সময় খাতায় ঢেলে দেওয়া। আর এই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই অধিকাংশ প্রচলিত পরীক্ষা চলে আসছে অর্থৎ একজন শিক্ষার্থী কতটা তথ্য ধরে রাখতে পারছে ক্লাসনোট থেকে, পাঠ্যবই থেকে। আর এটির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা তথ্য মুখস্থ করে এবং পরীক্ষার উত্তরপত্রে তার প্রতিস্থাপন ঘটায়। আর এ জাতীয় পরীক্ষায় সাফল্য নির্ভর করে কি পরিমান তথ্য একজন শিক্ষার্থী মুখস্থ করতে পারে, এবং কত দক্ষতার সাথে সেটি পুনরায় উপস্থাপন করতে পারে। কিন্তু  বিষয় পড়ানোর উদ্দেশ্য হচেছ শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক উপযুক্ততা, শক্তি এবং নমনীয়তা শান দেওয়া বা উন্নত করা। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে , ভাষার সংজ্ঞা দাও ’ এই জাতীয় প্রশ্ন অবান্তর।কারন সব শিক্ষার্থীই পাঠ্যবই কিংবা অন্যকোন  সূত্র থেকে এটি নকল করবে।নিজের কিছুই করার থাকছেনা। তাই,  উন্মুক্ত পদ্ধতির সবচেয়ে বড় উপকার হচেছ শিক্ষার্থী না বুঝে তথ্য মুখস্থ করার অভ্যাস পরিত্যাগ করবে। এক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা হবে একটি আনন্দঘন কাজ, সমস্যাবহুল এবং বোঝা নয়।আর আনন্দের মাধ্যমে যা শেখা যায় বা শেখানো যায় তা অধিক কার্যকরী এবং ধরেও রাখা যায় ভালভাবে। এটিকে বাস্তব জীবনে সহজে অ্যাপ্লাই করা যায়, অন্যত্র ব্যবহার করা যায়।

এখানে প্রশ্ন করার ধরন শিক্ষকদের একটু আয়ত্ব করতে হয়। প্রশ্ন এমনভাবে করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীর শুধুমাত্র বই থেকে তথ্য নিয়ে উত্তর দেওয়া বা শূন্যস্থান পূরন করার সুবিধাটা না পায়। তাদের নিজেদের চিন্তা করতে হয়। যেমন ঢাকা প্রথম কবে রাজধানী হওয়ার সম্মান অর্জন করে। সেটি  ১৬০৮ কিংবা ১৬১০ সালে। এ জাতীয় প্রশ্ন না করাই ভাল। করলেও হঠাৎ দু একটা হতে পারে। প্রশ্নহতে পারে ঢাকা যখন ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ছিল সেই ঢাকার সাথে বর্তমান ঢাকার একটি তুলনামূলক আলোচনা কর। এটি লিখতে শিক্ষার্থীর নিজের মত, বুদ্ধি ব্যক্ত করার সুযোগ পাবে। ঢাকা বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে একটি। এর কারন তোমার কাছে কি কি মনে হয়। এ জন্যই বই বন্ধ করে পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতির চেয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতি আলাদা। এতে সরাসরি উত্তর খুঁজে বের করার সুযোগ থাকেনা। কিন্তু ধারানাটা নিতে হবে পাঠ্যবই থেকেই। এই পদ্ধতিতে পাশে কেউ থাকলেও সরাসরি শিক্ষার্থীকে   সাহায্য করতে  পারেনা, পারলেও আলোচনা করতে হয় যার মধ্যে যুক্তিতর্ক থাকে যা ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল বৃদ্ধি করে। এমনসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে শিক্ষার্থীদের উচচতর দক্ষতা প্রদর্শনের কথা বলে। তারা শ্রেণিকক্ষে করা নোট, নিজের নোট, শিক্ষকের সামনে নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। 

এ ধরনের পরীক্ষা অনলাইনও দেওয়া যায়। এটি মৌখিক ও লিখিত—উভয়ভাবেই গ্রহণ করা যায়। তবে, এটি ভাবার অবকাশ নেই যে, উন্মুক্ত বই পরীক্ষা’ পদ্ধতি ট্রাডিশনাল বা ইনভিজিলেটেড পরীক্ষার বিকল্প। বই বন্ধ করে যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয় এখানকার প্রশ্ন তার চেয়ে আলাদা। এখানে পরীক্ষার্থীকে একটি দৃশ্য দেখানো হতে পারে যা বাস্তব চিত্র তুলে ধরে, বাস্তব অবস্থা তুরে ধরে। সেটির ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষার্থীকে একাধিক কাজ দেওয়া যেতে পারে, আলোচনার পরবর্তী স্তর কি হতে পারে ইত্যাদিও সন্নেবেশিত হতে পারে এই ধরনের পরীক্ষায়। তবে, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন হতে হবে  ভিন্ন ভিন্ন। এক এক শিক্ষার্থীর এক এক ধরনের প্রশ্ন। ফলে নকল করা, অন্য ধরনের অসৎ উপায় অবলম্বন করা কিংবা কাউকে জিজ্ঞেস করে উত্তর দেওয়া থেকে তারা বিরত থাকবে অর্থাৎ সেই সুযোগই রাখা হবেনা। এটি তাহলে মুখস্থ বিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করবে।

আমাদের দেশে মাঝে মাঝে অনেক শিক্ষার্থীরা এমনিক কিছু কিছু  অভিভাবকও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে অনেক সময় নষ্ট করেন  কিংবা প্রশ্ন ফাঁসের গুজবে কান দিয়ে মানসিকভাবে ভোগেন, নিজেদের সাথে নিজেরা প্রতারণ করেন, অসৎ উপায় অবলম্বন করেন। এগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারে যদি ‘ উন্মুক্ত বই পদ্ধতিতে’ পরীক্ষা গ্রহন করার ব্যবস্থা করা যায়।  এই ধরনের পরীক্ষার কিছু ত্রুটিও অবশ্য আছে। যেমন কিছু কিছু শিক্ষার্থী কোন তথ্য জানার চেষ্টা না করে, নিজে চিন্তা না করে পাঠ্যবইয়ের ওপর নিভরশীল থাকে। গভীরভাবে কোন কিছু ভেবে দেখেনা, ভেতরে ঢোকেনা। ভাবে, পরীক্ষায় যা আসবে তা পরীক্ষার সময় বই কিংবা নোট দেখে বের করে পরীক্ষা দিবে। সব পদ্ধতিরই ভাল খারাপ দুটো দিক থাকে। তবে, উন্মুক্ত পরীক্ষা পদ্ধতিতে ভাল দিকটাই বেশি মনে হচেছ। অত্এব, এই করোনাকালে আমরা এই পরীক্ষা পদ্ধতির কথা ভেবে দেখতে পারি। 
 
লেখক: মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064570903778076