দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: সারা বিশ্বের জন্যই বড় ধাক্কা ছিলো করোনা মহামারী, বাংলাদেশের জন্য তো বটেই। দেশের বহু প্রাণ স্মৃতি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কা সামলাতে হয়েছে স্কুলগামী শিশুদের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ৫ লাখ ১১ হাজার ৫৩৪ জন শিশু বিভিন্ন কারণে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে কভিডের প্রভাবে ছেড়েছে সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৫৯ জন। অর্থাৎ স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের ৩৩ শতাংশই এ মহামারীর ধকল সামলাতে পারেনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিশুশ্রম বেড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ খাতেও বেড়েছে শিশুশ্রম।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দ শেষে দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫। এদের মধ্যে বর্তমানে স্কুলে যায় ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৫ হাজার ১৯৪ শিশু। এক সময়ে স্কুলে গেলেও এখন বিভিন্ন কারণে যাচ্ছে না ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৫ শিশু। বাকি ২৪ লাখ ১ হাজার ১৪৬ শিশু কখনোই স্কুলে যায়নি। অর্থাৎ এ বয়সী শিশুদের ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ স্কুলে যাচ্ছে, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এক সময় স্কুলে গেলেও এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর ৬ শতাংশ শিশু কখনোই স্কুলে যায়নি।
যে ২৪ লাখ ১ হাজার ১৪৬ জন শিশু কখনোই স্কুলে যায়নি তাদের না যাওয়ার কারণও উঠে এসেছে জরিপে।
কখনোই স্কুলে না যাওয়াদের সবচেয়ে বেশি বা ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ বলছে, স্কুলে পড়ার খরচ খুব বেশি হওয়ায় অর্থের অভাবে তারা স্কুলে যায়নি। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অংশ ২১ শতাংশ জানিয়েছে, তারা পরিবারের বিভিন্ন ব্যবসা বা কৃষিকাজে সময় দেওয়ার কারণে স্কুলে যেতে পারেনি। ২০ দশমিক ৫ শতাংশ জানিয়েছে, পারিবারিক অন্যান্য গৃহস্থালির কাজে জড়িত থাকায় তারা স্কুলে যেতে পারেনি। জরিপে বলা হয়েছে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে ৫ লাখ ১১ হাজার ৫৩৪ জন। ঝরে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ কভিড-১৯ মহামারী। ঝরে পড়াদের ৩৩ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৫৯ শিশু শুধু মহামারীর কারণে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। তবে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মেয়েশিশুদের মধ্যে। কভিডে ঝরে পড়া শিশুদের ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছেলে আর ৪০ দশমিক ৬ শতাংশই মেয়ে।
কভিডে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৫৯ জন শিশুর মধ্যে ছেলে ৬৩ হাজার ৯৯৯ জন, যেখানে মেয়ে শিশু ১ লাখ ৫ হাজার ১৬০ জন।
স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বলছে, স্কুলের পড়ার খরচ বেশি হওয়ায় তারা স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ৭০ হাজার ৬৩৪ শিক্ষার্থী স্কুলের ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে টাকার অভাবে পড়তে পারেনি। তারা স্কুল ছেড়ে দেওয়াকেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত মনে করেছে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২
দেশে পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ শিশুশ্রম সংশ্লিষ্ট চতুর্থ জরিপ। এটি মূলত শ্রমজীবী শিশু, শিশুশ্রম এবং বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম সংশ্লিষ্ট তথ্যউপাত্ত সরবরাহ করে। জেনেভায় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস বা আইসিএলএস সম্মেলনে গৃহীত শিশুশ্রম সম্পর্কিত পদ্ধতি অনুসরণ করে এ জরিপটি পরিচালনা করা হয়।
জরিপে ১ হাজার ২৮৪টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) থেকে ৩০ হাজার ৮১৬টি খানা (১২টি নন-রেসপন্স খানাসহ) নির্বাচন করা হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬৪টি জেলা থেকে নমুনা পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছিল। এই জরিপের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত পরিচালিত হয়।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুসারে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৫ লাখ ৪০ হাজার শ্রমজীবী শিশু রয়েছে, যার মধ্যে ১৭ লাখ ৬০ হাজার শিশুশ্রমের বাইরে এবং ১৭ লাখ ৮০ হাজার শিশুশ্রমে রয়েছে। এ শ্রমজীবী শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম রয়েছে।
বর্তমানে দেশে গ্রাম এলাকায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার শ্রমজীবী শিশু রয়েছে এবং শহরাঞ্চলে রয়েছে ৮ লাখ ১০ হাজার। শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা গ্রাম এলাকায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ৩৪ লাখ ৪০ হাজার। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা গ্রাম এলাকায় ৮ লাখ ২০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ২ লাখ ৪০ হাজার রয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান বিষয়ক তথ্য রয়েছে। এই বয়সের মোট শিশু জনসংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার। যেখানে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ। দেশে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার পরিবারে ৫-১৭ বছর শ্রমজীবী শিশু রয়েছে এবং এ শ্রমজীবী শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির হার বর্তমানে ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
জরিপ ফলাফল অনুযায়ী, শিশু শ্রমিকের ৮২ শতাংশ তাদের নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করে। উৎপাদনে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং কৃষি, বনায়ন এবং মাছ ধরায় ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ নিযুক্ত রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, শিশু শ্রমিক কর্মচারী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং স্কুলে যায় ৫২ দশমিক ২ শতাংশ। শিশু শ্রমিকদের গড় মাসিক আয় ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা।
এছাড়াও ২০ লাখ ১০ হাজার শিশু গৃহকর্মী রয়েছে যাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না এবং ৮০ হাজার শিশু গৃহকর্মী পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত। শিশু গৃহকর্মীদের উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি।