আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি ৩০ মার্চ খুলে দেওয়া হয়, তাহলে সেটি হবে ৩৭৭ দিন পর, অর্থাৎ এক বছরেরও বেশি সময় পর। তবে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এটিও হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। হাঁপিয়ে উঠেছে শিশুরা। তারা তাদের সেই পরিচিত পরিবেশে ফিরত চায়, আড্ডা দিতে চায়, স্কুলমাঠে খেলতে চায়। এটি সত্য, শিক্ষার্থীরা এখন আর ঘরে বসে নেই। তাদের বাসায় ধরে রাখা সম্ভবও নয়। রোববার (২১ মার্চ) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, তারা হাটে, ঘাটে, মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং অনেকটা অনিরাপদ অবস্থার মধ্যেই। কিন্তু দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনই এ শিশুদের ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো জায়গা স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ বিদ্যালয়ে পারস্পরিক যে আত্মিক যোগাযোগ, মন খুলে কথা বলা, দুষ্টুমি করা, একত্রে পাঠগ্রহণ করার মধ্যে যে চঞ্চলতা রয়েছে, তা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যালয় যেহেতু তাদের এ পরিবেশটি তৈরি করে দিচ্ছে, তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যালয়ে ফেরার আকুতি করছে। সরকারের নিজস্ব প্রচেষ্টা, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার চেষ্টা, ওকালতি ও জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলো খোলা হচ্ছে।
এত বছর ধরে একটি সাধারণ রুটিন ছিল- ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা হবে; ফল বেরোনোর পর উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতো। এসব কিছুতে ছেদ পড়েছে করোনার কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। টানা বন্ধে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সৃষ্টি হয়েছে অন্তত দেড় বছরের সেশনজট। পরীক্ষাজটও লেগেছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজগুলোয়। সবকিছুই এলোমেলো করে দিয়েছে করোনা। ২০২১ সালের শিক্ষাবর্ষেও এসএসসি ও এইচএসসির সিলেবাস কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে সরকার। করোনায় বাতিল করতে হয়েছে সর্বশেষ এইচএসসি, প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। ২০২০ সালের বার্ষিক পরীক্ষাগুলোও বাতিল করতে হয়েছে। ফলে ঘরবন্দি শিশুরা গত বছরের পাঠ্যসূচির অনেক কিছুই রপ্ত করতে পারেনি। চলতি শিক্ষাবর্ষে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে সেসব পুষিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে ডজনখানেক প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়। ৩০ মার্চের আগেই শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাই শিক্ষা বিভাগের জন্য ১২ লাখ টিকা রিজার্ভ করা হয়েছে, যেটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য, সিলেবাস, কারিকুলাম ইত্যদি বিষয়েও সরকারের নানা সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রতিষ্ঠান খোলার পর চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাঠগ্রহণ শুরু করবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস শুরু করার প্রস্তুতি চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ঢোকার মুখেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ নতুন করে ওয়াশ ব্লক নির্মাণ করা হয়েছে, রাখা হয়েছে ফাস্ট এইড বক্স। এক লাখ শিক্ষককে সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্টের ওপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার উদ্যোগ। বিদ্যালয়ে এসে ঘরবন্দি থাকা শিশুদের কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা হলে তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারবেন তারা।
গত বছরের মে থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা ও জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাব, দুর্বল ও ধীরগতির ইন্টারন্টে সংযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তির উচ্চমূল্যের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষেই অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন ব্যাচের ভর্তিও পিছিয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোয় অন্তত ৫০০ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে ২৪ মে। ১৭ মে হল খোলা হবে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আবাসিক হলগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশের চলতি ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২০টি আবাসিক হল রয়েছে। সেগুলোয় প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী থাকেন।
করোনায় শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য এখন সুস্পষ্ট। শহুরে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছে। এমনকি পরীক্ষাও দিচ্ছে। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা স্কুল-কলেজের অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইন বা সরাসরি প্রাইভেট পড়ছে; কিন্তু দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এসবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। মফস্বলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের টেলিভিশন, স্মার্টফোন বা অনলাইন ক্লাসের জন্য অন্য কোনো ডিভাইস নেই। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন করে বৈষম্য দেখা দিয়েছে।
বিভিন্ন দেশের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘প্যান্ডেমিক ক্লাসরুম’ উদ্বোধন করেছে ইউনিসেফ। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, পুরোপুরি ও আংশিকভাবে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী ৮ কোটি ৮০ লাখের বেশি শিশুর পড়াশোনা অব্যাহতভাবে বাধার মুখে পড়ছে। প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হারিয়েছে। বাংলাদেশে ৩০ মার্চ স্কুল খোলার ঘোষণাকে ইউনিসেফ স্বাগত জানিয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে আমরাও স্বাগত জানাই এবং চাই-আগামী দিনগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দে কাটুক। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক