মানুষের মস্তিষ্ক চালিত সুকুমার বৃত্তি, চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-অনুভূতির সুস্থ পরিচালন ক্ষমতাকে মানসিক স্বাস্থ্য বলে। অর্থাৎ আমরা যা চিন্তা করি, অনুভব করি এবং সে অনুযায়ী স্বাধীন মতো প্রকাশের মাধ্যমে যে অনুশীলন করি তার স্বাভাবিক ও সুস্থ মনন চর্চাই হলো মানসিক স্বাস্থ্য। মন আর মানসিক স্বাস্থ্য দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা যেখানে যে অবস্থায় কাজ করি, সেখানকার সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার মাধ্যমে পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষতা, পরমত সহিষ্ণুতা, সহকর্মীদের মাঝে মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্বাধীনতা এবং অযথা বিরক্তিকর কোনো হস্তক্ষেপ না করার যে সুশীল ও সুস্থ আচরণগত চর্চা, তাকে কর্মক্ষেত্রের মানসিক স্বাস্থ্য বলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়। আমরা বলতে পারি শুধুমাত্র ব্যক্তির শারীরিক এবং সামাজিক অবস্থার সমন্বয়ে একজন ব্যক্তি কখনোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে না। বরং তাকে অবশ্যই মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে।
আমাদের কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিষেবা অনেক প্রয়োজন। শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার দায় অনেকটাই ব্যক্তির নিজের অভ্যাসের ওপর, যেমন পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়ম মেনে চলা, পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেয়া এবং চিত্তবিনোদন করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে। কিন্তু, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য অনেকগুলো অনুঘটক থাকে। ব্যক্তি নিজের মতো করে চলার যে সদিচ্ছা ও স্বাধীনতা, তা খর্ব হলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে তার জীবন-জীবিকা ও পরিবারের স্বচ্ছলতা আনার তাগিদে কাজ করতে হয় বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। কেউ হয়তো ফ্রিল্যান্সিং করেন, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য, কেউবা করপোরেট জব বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে চাকরি। দিনের গুরুত্বপূর্ণ বড় একটি সময় তারা তাদের স্ব স্ব কর্মস্থলে কাটিয়ে থাকেন। এমতাবস্থায়, আমরা যে যেখানে কাজ করি, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত আবশ্যক।
কর্মক্ষেত্রে যে সমস্ত বিষয়ের ওপর ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে, মূলত সে সমস্ত বিষয়কে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের উপাদান বলে থাকি। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রধান প্রধান উপাদানগুলো হচ্ছে- ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক অবস্থা, মতপ্রকাশ ও নিজের মতো করে কাজ করার স্বাধীনতা, চিত্ত বিনোদনের সুযোগ, ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থা, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সহচার্য, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম, ব্যক্তির দায়িত্ব এবং কর্তব্যের পরিধি এবং কর্তৃপক্ষের সুবিচার ও পক্ষপাতহীন মোটিভেশন। এগুলো একজন ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে।
কর্মক্ষেত্রে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে কোম্পানি বা সংস্থার স্বাভাবিক বৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি সাধিত হয়। তাই কর্মক্ষেত্রে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও ইতিবাচক মানসিকতা প্রদর্শন করতে কর্তৃপক্ষের যেসব পরিষেবা রয়েছে সেগুলো নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৩৬ কর্মদিবস বিষণ্নতার কারণে নষ্ট হয়। ইউরোপে কাজ-সংক্রান্ত বিষণ্নতার কারণে বছরে ৬১৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে এবং জনমনে সচেতনতা তৈরি করতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব সাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিলো ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’।
কর্মক্ষেত্র যেমন হতে পারে একজন মানুষের ভালো থাকার অন্যতম উৎস, তেমনি এই কাজই হতে পারে মনঃসামাজিক চাপ এবং অনুৎপাদনশীলতার অন্যতম কারণ। বিশেষত যেসব কারণে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটে এবং সেখানে কর্তৃপক্ষের দায় থাকে, তার অন্যতম প্রধান কারণগুলো হলো-সিনিয়র ও জুনিয়র সহকর্মীদের মধ্যে কর্মের অসম বন্টন, প্রতিষ্ঠানে কোনো নতুন সহকর্মী যোগদান করলে তাকে ভালোভাবে গ্রহণ না করা এবং সিনিয়রদের কাজ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে কাজের সুষম বন্টন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিনিয়র ও জুনিয়রদের আচরণগত বৈষম্য সহকর্মীদের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হয়। একইসঙ্গে সেটি মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
ব্যক্তির কর্মক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ ও জটিল কাজ অর্থ্যাৎ যখন অনেক কাজ অল্প সময়ে স্বল্প ব্যবস্থাপনার মধ্যে করতে হয়, তখন কর্মীদের মাঝে মানসিক চাপ তৈরি করে। কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে একটি ফ্লেক্সিবল ও ভারসাম্যপূর্ণ কর্মনীতি নির্ধারণ করতে পারে।
অতিরিক্ত কাজ বা বেশি ওয়ার্ক লোড যেমন কর্মীদের মানসিক চাপ তৈরি করে, ঠিক তেমনি অফিসে কম কাজ থাকলে, সেখানে ব্যক্তির দক্ষতা ঠিকভাবে ব্যবহৃত না হওয়ায় সেটা বিষণ্নতা তৈরি করতে পারে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। কাজেই কর্তৃপক্ষের উচিত প্রত্যেক কর্মীর দায়িত্ব সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ আদায় করে নেয়া।
কখনো কখনো কর্তৃপক্ষ বা অফিসের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে দ্বৈতনীতি ও অসম আচরণ করে থাকেন। এতে সহকর্মীদের মাঝে ভীষণ অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং তাদের মানসিক চাপ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিরপেক্ষ থেকে সবার প্রতি সমান আচরণ করতে হবে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল্যায়নের বড় একটা মাপকাঠি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেতন বা পারিশ্রমিক হলেও, তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি না পেলে তারা আত্মগ্লানিতে ভোগেন। কর্তৃপক্ষ অনেক সময় অন্যের কানকথা বিশ্বাস করে কোনোরকম বাছবিচার না করেই অন্যদের অবমূল্যায়ন করে থাকেন। এ কারণেই তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সুতরাং, আর্থিক সুবিধা, মৌখিক প্রশংসা, কাজের স্বীকৃতি, পুরস্কার ইত্যাদির মাধ্যমেও হলেও ব্যক্তিকে মূল্যায়িত করা এবং বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা উচিত।
কর্মস্থলে নির্দিষ্ট বেতনকাঠামো, সঠিক সময়ে বেতন ও পারফরম্যান্স অনুযায়ী নিয়মিত প্রমোশন বা পদোন্নতি না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে মানসিক পীড়া তৈরি হয় এবং তাতে কর্মস্থলে কাজের পরিবেশও নষ্ট হয়। সুতরাং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের প্রাপ্য অধিকারটুকু কর্তৃপক্ষের আদায় করা উচিত।
কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতমূলক আচরণ, দুর্ব্যবহার, অবিশ্বাস, ভুল বোঝাবুঝি ও গুপ্তচরবৃত্তি করা কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্য নষ্টের বড় একটি কারণ। কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে মূল্যায়নভিত্তিক ও জবাবদিহিতামূলক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। তাতে যার পারফরম্যান্স ভালো হবে তাকে পুরস্কৃত এবং যার কাজ অসন্তোষজনক হবে তাকে ভালো করার জন্য মোটিভেশন দেয়া উচিত।
কর্মী যখন বুঝে উঠতে পারেন না তার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা হচ্ছে অথবা প্রত্যাশাগুলো যদি তার দায়িত্বের সঙ্গে খাপ না খায়, তাহলেও কাজে অনাগ্রহ আসতে পারে। কার কাজ কোনটি বা কর্মীর পদ অনুযায়ী তার কাজের নিযুক্তি ঠিক না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। তাই নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্টভাবে লিখিত দেয়া উচিত।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অবিবেচক, কর্তৃত্বমূলক ও অসহযোগী সুপারভিশন, সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক, মানসিকভাবে হেনস্তা করা (খারাপ সমালোচনা, অশোভন মন্তব্য, যৌন হয়রানি, ব্যক্তিগত বিষয়ে অহেতুক কৌতূহল বা নাক গলানো) ইত্যাদি কর্মস্থলে মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতা বাড়িয়ে দেয়। কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত।
ব্যক্তিগত বিষয়ে কর্মক্ষেত্রের অসহযোগিতা এবং বাসার কাজের বিষয়ে পরিবারের অসহযোগিতার কারণে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। অফিস ও বাসার কাজের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা আবশ্যক।
প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মী থাকে এবং তাদের প্রত্যককেই তার ঊর্ধ্বতনকে নিয়মিত রিপোর্ট করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অধস্তন ব্যক্তিবর্গ তার ইমিডিয়েট লিডারকে রিপোর্ট না করে অন্যান্য ঊর্ধ্বতনকে বা সরাসরি মালিকপক্ষকে রিপোর্ট করে নিজের স্বার্থ হাসিলের উপায় হিসেবে রিপোর্ট করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এতে চেইন অব কমান্ড ব্রেক হয়, যার ফলে কর্মক্ষেত্রে সুস্বাস্থ্যের অবনতি হয় এবং একটি নোংরা পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সুতরাং কর্তৃপক্ষের উচিত চেইন অব কমান্ড মেনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা।
অতএব খেয়াল রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্যের অসুস্থতা কর্মক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ নানা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, মনঃসংযোগ করতে না পারা, কাজে অনুৎসাহ, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া ইত্যাদি।
যখন আমরা ভালো মানসিক স্বাস্থ্য উপভোগ করি, তখন আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর অনুভূতি থাকে, আমরা যা করতে চাই তা করার শক্তি এবং আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার ক্ষমতা থাকে। প্রতিদিনের একটি বড় অংশ আমরা কাটাই কর্মক্ষেত্রে। ফলে এই দীর্ঘ সময়টা কেমন যাচ্ছে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারণ করে আমাদের সার্বিক ভালো থাকা, না থাকার ওপর।
চাকরি বা কাজ যে শুধু আমাদের আর্থিক নিরাপত্তা দেয় তা নয়, আমাদের নিজস্ব আত্মপরিচয়ও তৈরি করে। নিজের আত্মমর্যাদা, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। কাজের মাধ্যমে আমাদের নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং সামাজিক অবস্থানও দৃঢ় হয়। শুধু তাই নয়, কাজ যতো সামান্যই হোক, এর মাধ্যমে আমাদের মেধা, মনন, দক্ষতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাজে লাগানোর সুযোগ ঘটে। কর্মী, বস ও বসের বস তথা কর্তৃপক্ষের আচরণ, পেশাদার নৈতিকতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আত্মসম্মান চেতনার ওপর নির্ভর করে কর্মক্ষেত্রে শান্তি। এমনকি কাজের পুরো পরিবেশটা কর্মীবান্ধব কতোখানি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এবং কর্মের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে কর্তৃপক্ষের অনেক দায় থাকে। সেগুলো যথাযথ পালন করা তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মনিব-ভৃত্যের আচরণ করলে বা তাদের প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার সঠিক মূল্যায়ন না করলে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে এবং সেখানে কাজের সুস্থ পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তাই কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে আসুন একে অন্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহযোগিতামূলক মনোভাব ও পক্ষপাতহীন নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র তৈরি করি এবং কর্মী ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি ইতিবাচক সেতুবন্ধন গড়ে তুলি।
লেখক: অধ্যক্ষ