কিশোরগঞ্জের দিকে কিছু লোকের ‘ভাদাইমা’ বলে একটা পরিচিতি আছে। কাজের উপযুক্ত কিন্তু কাজ করে না, ঘুরেফিরে আর খায়, লেখাপড়া করে না, প্রশিক্ষণও নেয় না-এমন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে মানুষ ‘ভাদাইমা’ বলে ডাকে। এখন প্রশ্ন, ‘ভাদাইমা’ ও ‘নিষ্ক্রিয়’ লোকের মধ্যে কি কোনো তফাৎ আছে? প্রশ্নটির উত্তর দরকার। কারণ, দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর এক হিসাব বলছে, তরুণদের ৪১ শতাংশ কাজে নেই, শিক্ষায়ও নেই। বলা হয়েছে, এ হার মেয়েদের মধ্যে বেশি, ছেলেদের মধ্যে কম। এর অর্থ হচ্ছে, তারা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই, এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। শনিবার (২ মার্চ) দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে সাধারণভাবে বেকারত্বের হার সাড়ে ৩ শতাংশ, অথচ তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ। আবার দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার হার যত বেশি, বেকারত্বের হার তত বেশি। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে এ হার প্রায় ১২ শতাংশ। দেশের মোট বেকারের ২৫ শতাংশ হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত। নিষ্ক্রিয়তার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নিষ্ক্রিয় তরুণের বাস সিলেটে। কম বরিশালে-৩৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। সিলেটে এ হার ৪৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। মজার বিষয় হচ্ছে, অনুন্নত রংপুর বিভাগে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে তা ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি তরুণের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি ১৬ লাখ। এই তরুণদের মধ্যে ১ কোটি ২৯ লাখ নিষ্ক্রিয়।
নিষ্ক্রিয়তার অনেক কারণ দেখানো হয়েছে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা অনেক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে বাল্যবিয়ের কথা। বাকি ক্ষেত্রে যেসব কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আছে : কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানে ঘাটতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, শোভন কাজের অভাব এবং সামাজিক পরিস্থিতি। এখানে একটি বোঝার বিষয় আছে। ‘ভাদাইমা’, ‘বেকার’ ও ‘নিষ্ক্রিয়’ লোকের মধ্যে তফাৎ কী? তফাৎ নিশ্চিয়ই আছে। তবে তা সাদা চোখে ধরা যায় না। ‘ভাদাইমারা’ কাজ করতে চায় না, এটা কি বলা যায়? ‘নিষ্ক্রিয়’ লোক কি ‘বেকার’ লোক নয়? কী তফাৎ ‘নিষ্ক্রিয়’ ও বেকারের’ মধ্যে? এসব পরিষ্কার হওয়া দরকার। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘বেকারত্বের’ সংজ্ঞা। বস্তুত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বেকারত্বের যে সংজ্ঞা, তা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে মোটেই প্রযোজ্য নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও)। তাদের মতে, একজন ব্যক্তি যদি সর্বশেষ সপ্তাহে (সাত দিনে) এক ঘণ্টা কাজ করে কিছু অর্থ পান, তাহলে তিনি ‘বেকার’ নন। আমাদের দেশে ঘণ্টাপ্রতি কোনো কাজ আছে? মাসিক ভিত্তিতে বেতন, নয়তো দৈনিক মজুরি-এই হচ্ছে আমাদের হিসাব। কিন্তু আইএলও বলছে ভিন্ন হিসাবের কথা।
তর্কের খাতিরে ওদের ‘বেকারত্বের’ সংজ্ঞাও যদি ধরেও নেই, তাহলেও তো বেকারত্বের/নিষ্ক্রিয়তার তথ্য ভয়াবহ। অর্থাৎ মোট তরুণের ৪১ শতাংশেরই এক সপ্তাহের মধ্যে একটাও কাজ ছিল না বা নেই! এবং তারা কোনো শিক্ষায়ও নেই, কোনো প্রশিক্ষণেও নেই। এদের ‘ভাদাইমা’ বলা হবে কিনা, তা অবশ্যই বিবেচ্য। ‘নিষ্ক্রিয়’ হচ্ছে ভদ্র শব্দ। এসব শব্দের ব্যাখ্যা থাকা দরকার। কারণ আমরা এখন বলছি ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে’র (জনমিতি সুবিধা) কথা। এ সুবিধার মধ্যে পড়ে ১৫ বছর থেকে ২৪ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীরা। তাদের কাজের মাধ্যমেই আমাদের জনমিতি সুবিধাটা ধরতে হবে। কিন্তু দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে আমরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে।
সারা দেশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সিলেটের তরুণরাই সবচেয়ে পেছনে। সিলেটের বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে না। ওখানকার তরুণরা কি লেখাপড়া করতে চায় না? তারা কি কোনো প্রশিক্ষণ নিতে চায় না? ওরা কি কোনো কাজকর্ম করতে চায় না? সাধারণতভাবে বলা হচ্ছে, সিলেটের তরুণরা বিদেশমুখী। তারা একটু লেখাপড়া করা অবস্থায়ই বিদেশে যেতে আগ্রহী হয়। সিলেটের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী ইংল্যান্ডে বেশ প্রভাবশালী। দুই-তিন ‘জেনারেশন’ ধরে তারা সেখানে। ওরা দেশ থেকে আত্মীয়স্বজনকে ওই দেশে নিয়ে যেতে চায়। এ কারণে সিলেটের তরুণরা নাকি লেখাপড়ায় আগ্রহী নয়।
দেখা যাচ্ছে, এমন একটা পরিস্থিতি অন্যান্য জেলায়ও তৈরি হচ্ছে। দেশে কাজ নেই, উপযুক্ত কাজ নেই, কাজের অভাব, মজুরি কম-এসব কারণ দেখিয়ে সারা দেশের তরুণরাই মধ্যপ্রাচ্যে, অন্যান্য দেশে যেতে বেশি আগ্রহী। অবকাঠামোর অভাব, স্কুল-কলেজ-কারিগরি শিক্ষালয়ের অভাব, পরিবেশ-পরিস্থিতির অভাব এ অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে। আবার তরুণরা এও দেখছে যে, ধনী, অতিধনী, শিক্ষিত শ্রেণির লোকেরা দেশত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। এসব ঘটনা তাদের বিদেশ গমনে উৎসাহিত করছে। এ কারণে তারা স্কুল, কলেজ, কারিগরি প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে ঘোরে ‘ম্যান পাওয়ারের’ দালালদের পেছনে। জমাজমি বিক্রি করে, ধারদেনা করে তারা বিদেশে যেতে চায়। লেখাপড়া দিয়ে কী হবে! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। শিক্ষিতরা ঘুরঘুর করছে চাকরির জন্য। সবাই চাকরি চায়। আগে বেসরকারি চাকরিতে যেতে চাইত যুবকরা, এখন তা আর সত্য নয়। ওখানে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেতন-ভাতা, ছুটি, সুযোগ-সুবিধা কম। এ কারণে সবাই এখন চায় সরকারি চাকরি। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এ চাকরিতে অনেক বেশি-‘আসলে গেলে বেতন পাই, কাজ করলে ওভারটাইম পাই’র মতো অবস্থা। এ কারণে সরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য তরুণরা লাখ লাখ টাকা ‘খরচ’ করতে প্রস্তুত। বাজারে এ সম্পর্কে অনেক কথা চালু আছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত।
বেসরকারি খাত বড় হচ্ছে। সেখানে বিচিত্র পেশার চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি খাতের অভিযোগ-তারা প্রয়োজনীয় দক্ষতার তরুণ পাচ্ছে না। দেশে দরকার বিভিন্ন ধরনের মেকানিক-টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদির মেকানিক দরকার। ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতাসম্পন্ন লোক দরকার। ইনটেরিয়র ডেকোরেশনে অভিজ্ঞ কারিগর দরকার। বলাই বাহুল্য, দেশে পাওয়া যাচ্ছে বিবিএ, এমবিএ-যাদের অধিকাংশেরই কোনো উপযোগিতা নেই। এসব কারণেই সাধারণ লেখাপড়ার দিকে তরুণরা আকৃষ্ট হচ্ছে না। আবার তারা কারিগরি লেখাপড়ার দিকেও আগ্রহী হচ্ছে না। তরুণরা কৃষিকাজ করতে চায় না। কৃষি সাধারণভাবে লাভজনক পেশা নয়, গ্রামের কৃষকরা কৃষিতে জড়িত হয় বাধ্য হয়ে। যুগ যুগ ধরে তারা ঠকছে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি, অথচ এর মূল্য নেই। এ কারণে তরুণরা কৃষিকাজে উৎসাহিত নয়। আজকাল অবশ্য যন্ত্রে অনেক কাজ হচ্ছে। কিছু কিছু তরুণ এসবে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক তরুণ ‘বেকার’, ‘নিষ্ক্রিয়’, ‘ভাদাইমা’।
এর থেকে পরিত্রাণ কী? সম্পূর্ণ পরিত্রাণের উপায় কী, সে কথা আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে এ মুহূর্তে একটি সীমিত উদ্যোগের কথা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। যাদের উদ্ভাবনী, সৃজনী শক্তি আছে, যাদের নতুন উদ্যোগ নেওয়ার সাহস আছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তহবিল গঠন করেছে ২-৩ বছর আগে। এর নাম ‘স্টার্ট আপ’ তহবিল। এ তহবিলে জমা আছে ৮৪০ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা এ তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া যায়। সুদের হার মাত্র ৪ শতাংশ। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ দেওয়া হয়। ‘স্টার্ট আপ’ ব্যবসা কী? নতুন সেবা ও পণ্য, নতুন প্রসেসিং, নতুন প্রযুক্তির ব্যবসাকেই স্টার্ট আপ ব্যবসা বলা হয়। এ ঋণ গ্রহণের সময় কোনো ‘জামানত’ লাগে না। এটা একটা বিশাল সুবিধা। কারণ, সাধারণত ঋণের জন্য জামানত দিতে হয়। কিন্তু অনেকের জামানত দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। তাই নিয়ম হয়েছে, ‘স্টার্ট আপের’ ক্ষেত্রে কোনো জামানত লাগবে না। জামানত হবে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি (পার্সোনাল গ্যারান্টি), শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ পাবে মাত্র আধা শতাংশ সুদে। আর ব্যাংকগুলো ঋণ দেবে ৪ শতাংশ সুদে। ঋণ তদারকি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ আদায়ের দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের। ব্যাংক ও গ্রাহকদের সুবিধার্থে এসব ঋণের হিসাবায়ন, শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিংয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সব ঠিকই আছে। কিন্তু এ ‘স্টার্ট আপ’ ঋণ বিতরণের অবস্থা কী? এক কথায়, মোটেই ভালো নয়। এর দুটি কারণ। প্রথমত, নতুন উদ্যোক্তাদের অভিযোগ-তারা ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরে নাজেহাল। ‘পয়সার’ ব্যাপার আছে। ব্যাংকের কথা-ছোট ছোট ঋণের ঝুঁকি বেশি। এর জন্য মনিটরিং খরচও বেশি। তদারকিতে যে খরচ তাতে এ ব্যবসা ব্যাংকের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। এর চেয়ে বড় বড় ঋণে ব্যাংকের সুবিধা বেশি। মনিটরিং খরচ কম। সুদ আয় বেশি। ঝুট-ঝামেলা সেখানে কম। এ অবস্থায় পড়ে, পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যে ‘স্টার্ট আপ’ ব্যবসা এগোচ্ছে না। আরও বড় সমস্যা আছে এতে। এসব ঋণের ক্ষেত্রেও ‘তদবির’ খুব বড়। দলীয় বিবেচনা সামনে এসে পড়ে। ব্যাংকারদের দুই হাত এমনিতেই পোড়া। আর কত পোড়াবে হাত। বদনামের শেষ নেই তাদের। এ অবস্থায় স্টার্ট আপের অধীনে ঋণ প্রদানে বিশেষ অগ্রগতি নেই। এখানে আবার মেয়েদের জন্য আলাদা বরাদ্দের ব্যবস্থা আছে। এক্ষেত্রেও অগ্রগতি সামান্যই।
একদিকে ‘নিষ্ক্রিয়তা’, ‘বেকারত্ব’, ‘ভাদাইমা’ পরিস্থিতি, অন্যদিকে ‘স্টার্ট আপ’ ব্যবসার ব্যর্থতা-এসব কী বলে আমাদের? ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’, যার কথা আমরা এত বলছি, তার কী হবে? সময় তো গড়িয়ে যাচ্ছে। তরুণদের ‘ভাদাইমাগিরি’ থেকে মুক্ত করতে, নিষ্ক্রিয়তা থেকে ক্রিয়াশীল করার জন্য আমাদের শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। ঘরে ঘরে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় করে বিবিএ, এমবিএ, এমএ, এমকম তৈরি করার অগ্রাধিকার থেকে আমাদের কারিগরি শিক্ষার দিকে যেতে হবে। এখানে শিক্ষক দিতে হবে, অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। প্রচুর বরাদ্দ দিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কথা বলে সিলেবাস তৈরি করতে হবে।
লেখক: ড. আর এম দেবনাথ, অর্থনীতি বিশ্লেষক, সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়