দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: ময়মনসিংহ-৪ আসনে অবস্থিত নাসিরাবাদ কলেজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মোহাম্মদ মোহিত উর রহমানের বিরুদ্ধে। তিনি নিয়ম বহির্ভূতভাবে কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচনের জন্য কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দেন বলে জানা গেছে। পরে কলেজ বন্ধ থাকলেও নতুন বিদ্যোৎসাহী সদস্য নির্বাচন করা হয়। এই খবরে শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজ চত্বরে মানববন্ধন করেন। পরে তারা অধ্যক্ষের কার্যালয়ে গিয়ে বিদ্যোৎসাহী সদস্যকে অপসারণ না করা পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন।
গত রোববার (২১ এপ্রিল) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) ফাহিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি করা হয় জেলা প্রশাসককে। একই সঙ্গে বিদ্যোৎসাহী সদস্য করা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও হালুয়াঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ খানকে। আগের কমিটির মেয়াদ ২২ এপ্রিল শেষ হলে ২৩ এপ্রিল থেকে নতুন কমিটির কার্যকারিতা শুরু হয়। সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত করে দিলেও কমিটির অন্যান্য সদস্য স্থানীয় ভাবেই নির্বাচিত হন। তফসিল অনুযায়ী চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনের দিন নির্ধারিত ছিল।
বিগত কমিটিতে সভাপতি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সহ সভাপতি আমিনুল হক শামীম ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ড. মোল্লাহ আমিনুল ইসলাম। নতুন সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য নির্বাচনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ দুটি পদেই তিনজনকে সদস্যের নাম অন্তর্ভূক্ত করে প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু সেই প্রস্তবনা থেকে সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করেনি বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
নতুন বিদ্যোৎসাহী সদস্যের খবর গত মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানাজানি হয়। পরে গত বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজ চত্বরে জড়ো হন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যনারে আয়োজিত কর্মসূচিতে বিতর্কিত ব্যক্তিকে গভর্নিং বডিতে সদস্য করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বিদ্যোৎসাহী সদস্যকে প্রত্যাহার করে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিকে সদস্য করার দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা। ওই সময় বক্তব্য রাখেন মাসুদ রানা, তাহসিন জুনায়েদ জয়, আকাশ আহমেদ, নাফিস আহমেদ প্রমুখ। পরে তারা কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে গিয়ে বিদ্যোৎসাহী সদস্যকে অপসারণ না করা পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র মাসুদ রানা বলেন, যিনি বিদ্যোৎসাহী সদস্য হয়েছেন তার অতীত ইতিহাস ভালো নয়। আমরা চাই না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলঙ্কিত হোক। তাই এই সদস্যকে অপসারণ করে নতুন যোগ্য ব্যক্তিকে সদস্য নির্বাচিত করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা নতুন বিদ্যোৎসাহীকে অবাঞ্চিত করলাম।
তবে এ বিষয়ে নব নির্বাচিত বিদ্যোৎসাহী সদস্য ফারুক আহমেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কলেজের অধ্যক্ষ আহমেদ শফিক বলেন, সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রস্তাব কলেজ থেকে পাঠানো হয়নি। এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। তারা লাগাতার আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে।
জানা যায়, এমপি মোহিত উর রহমান জাতীয় সংসদের প্যাডে দেওয়া ডিও লেটারে তার আস্থাভাজন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফারুক আহমেদ খানকে কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি করার জন্য সুপারিশ করেন, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পরিপন্থী।
গত ১৪ মার্চ দেওয়া ওই ডিও লেটারে তিনি উল্লেখ করেন, তার বাবা সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ধর্ম মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এই কলেজে তার শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। এই কলেজের সঙ্গে তার পরিবারের অসংখ্য স্মৃতি জড়িত ও কলেজটির উন্নয়নে তার বাবার অবদান রয়েছে। এমতাবস্থায় তিনি কলেজটির গভর্নিং বডিতে নিজের পছন্দের লোককে সভাপতি হিসেবে মনোনিত করতে চান।
অথচ, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে গভর্নিং বডির নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের গভর্নিং বডি (সংশোধিত) সংবিধি -২০১৯ এর ধারা -২৭ অনুযায়ী গভর্নিং বডির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস পূর্বে বিভিন্ন ক্যাটাগরি যেমন- শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠাতা, দাতা এবং হিতৈষী প্রতিনিধি নির্বাচনের নিমিত্তে গভর্নিং বডির সভায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।
ওই কমিশনের তিনজন সদস্য হবেন- ১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত গভর্নিং বডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য, ২. গভর্নিং বডি কর্তৃক মনোনীত এমন একজন শিক্ষক যিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না এবং ৩. অধ্যক্ষ, যিনি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। গভর্নিং বডি গঠনের জন্য বিধি মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠন করে এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। না হলে কমিটি গঠনের আবেদন বিবেচনা করা হবে না বলেও ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা আছে।
তবে, বর্তমান সংসদ সদস্য এসব নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের পছন্দের লোককে কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি করেন।
এদিকে, এসব অনিয়ম রোধ করতে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (নং ৪৭৮৮ অব ২০২৪) দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নাসিরাবাদ কলেজের বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি আমিনুল হক শামীম জনস্বার্থে এই রিট করেছেন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে জাস্টিস মো. খাসরুজ্জামান ও জাস্টিস কে এম জাহিদ সারওয়ারের আদালত ওই ডিও লেটারের কার্যকারিতার ওপর স্টে অর্ডার জারি করেছেন।