কারাবন্দির ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এখন মৃত্যুরও কারণ

মাহফুজ আনাম |

লেখক, সচেতন নাগরিক, মধ্যপন্থী বিরোধী কণ্ঠস্বর এবং চলমান ঘটনার পর্যবেক্ষক ও সমালোচক মুশতাক আহমেদ এখন মৃত। ময়না তদন্তের পরে তার মৃত্যুর কারণ বিষয়ে ধারণা পেয়েছি। কিন্তু, মৃত্যুর আসল কারণ আমরা ইতোমধ্যেই জানি- একটি নিষ্ঠুর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে যে কাউকে তুলে নেওয়া যায়, কারাবন্দি করা যায়, অস্পষ্ট ‘অপরাধে’র অগণিত অভিযোগ আনা যায় এবং মাসের পর মাস বিনা বিচারে, জামিন না দিয়ে, কোনো কারণ ব্যাখ্যা না করেই কারাগারে আটকে রাখা যায়। আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা আছে যার কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতা এখন ক্ষমতাসীনদের খেলার পুতুলে পরিনত হয়েছে। এসব ঘটনার যেন প্রতিকার নেই। শুক্রবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। লিখেছেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অমানবিক ব্যবহার, কোনো কারণ না দেখিয়েই প্রায় ১০ মাস কারাবন্দি করে রাখা, ছয় বার জামিন আবেদন বাতিল করা, আইনের অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরানো এবং অন্যায়ভাবে লেখক ও ভাষ্যকার মুশতাক আহমেদের জীবনকে অন্ধকারের অতল গহ্বরে ঠেলে দেওয়া ছাড়া এটা আর কিছুই না। বাস্তবতা এতটাই নিষ্ঠুর এবং যুক্তির বাইরে যে বেঁচে থাকাই যেন অর্থহীন।

মুশতাক আহমেদ কারাগারে মারা গেলেন। তার অপরাধ কী ছিল? বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সর্বোচ্চ ১০৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা এবং চার্জশিট জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু, তদন্তকারীরা এই সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করার আট মাস পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। কারো স্বাধীনতা কি কেবল পুলিশের ‘মনে হওয়ার’র ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়?

বিচার বিভাগের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখেই আমাদের প্রশ্ন, প্রায় ১০ মাস ধরে বিনা বিচারে কারাগারে থাকাই কি তাকে জামিন দেওয়ার জন্য যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি হওয়া উচিত ছিল না? ছয় বার জামিন প্রত্যাখ্যান করার সময় সংবিধান যে মৌলিক অধিকার অভিযুক্তদের দিয়েছে, তা কি নিশ্চিত করা হয়েছিল?

এরপর প্রশ্ন আসে, মুশতাক আসলে কী এমন করেছিলেন যার জন্য তাকে কারাবন্দি করা হয়েছিল? তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কিছু পোস্ট করেছিলেন এবং অন্যদের কিছু পোস্ট শেয়ার করেছিলেন। এসব পোস্টে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারের অন্যান্য কিছু ব্যবস্থার বিষয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। এখানে অপরাধ কোথায়? তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো। কিন্তু এসব অপরাধের কোনো প্রমাণই দেননি তদন্তকারীরা। ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি আসলে কী পোস্ট করেছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই দিতে পারেননি তদন্তকারীরা।

ধরে নিলাম তাকে গ্রেপ্তারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে সেটা সঠিক। কিন্তু, তাই বলে কোনো কারণ না দেখিয়েই তাকে প্রায় ১০ মাস কারারুদ্ধ করে রাখা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? শুধু তাই নয়, যুক্তিসঙ্গত কারণেই আমরা বিশ্বাস করি যে তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আইন লঙ্ঘনের কোনো রেকর্ড না থাকা বা আগে কখনও অপরাধী হিসেবে চিহ্ণিত না হওয়া দেশের একজন নাগরিকের সঙ্গে কি আমাদের এমনই আচরণ হওয়া উচিত?

অস্বীকার করতে করতে আমরা হয়তো মুখে ফেণা তুলে ফেলতে পারি, কিন্তু মারাত্বকভাবে মুশতাক আহমেদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আমরা অপরাধী। ‘অপরাধে’র কোনো প্রমাণ না দিয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এটা বলে দেওয়া যথেষ্ট নয় যে মুশতাক আহমেদ সরকার ও দেশবিরোধী কথা বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মুশতাক আগেও লেখালেখির মাধ্যমে মানুষের মনে আঘাত দিয়েছেন।’ কীভাবে, কোথায়, কী নিয়ে আঘাত দিলেন তা তিনি বললেন না।

আরও অনেককেই একই ধরনের অভিযোগে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। অবিলম্বে তাদের কারামুক্তির দাবি জানাচ্ছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধে দ্রুত এর সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি। ইতোমধ্যেই এর অপব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এই আইনে যাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে তারা নয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026710033416748