কী খবর মেরুদণ্ডের

বোরহানুল হক সম্রাট |

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কী খবর সেই মেরুদণ্ডের? আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা বিপরীতভাবে বুঝিয়ে দিয়ে চলেছে, বিজ্ঞজনেরা অতীতে কেনো বার বার এই মেরুদণ্ডের কথা বলে গেছেন। 

সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে একটি কলেজে ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছেন ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরিচিত হওয়ায় ওই কলেজের অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করেছিলাম, ইংরেজির শিক্ষককে কী এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে না? মহোদয় জানালেন, সুযোগ নেই। কারণ ওই দুই শিক্ষক দলীয়ভাবে প্রভাবশালী। তিনি (অধ্যক্ষ) আকারে ইঙ্গিতেও তাদের কিছু বলতে পারবেন না।

অবশ্য তাদের অনুপস্থিতিতে অন্যরা এসব নিয়ে খুব সাবধানে একটু আধটু ফিসফাস করেন, সমালোচনা করেন। তবে সবসময়ই এই ভয়ে থাকেন যে, কোনো না কোনোভাবে আবার জানি ওদের কানে এসব সমালোচনা পৌঁছে যায়!

ইংরেজির ওই দুই শিক্ষক যে সামান্য সংখ্যক ক্লাস নেন, সেগুলোতে কীভাবে তারা পাঠদান করান সে কথা মনে এলেও মুখে ফোটে না। ফলে ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের ভাগ্য এভাবেই ঝুলে থাকে সব সময়। এটি কেবল এই একটি কলেজের অবস্থা নয়, শত শত কলেজেও ঘটতে পারে। 

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরীকে অকথ্য নির্যাতনের পর ছাত্রলীগ নেত্রী হল প্রাধ্যক্ষকে নির্দেশ দেন ওই ছাত্রীকেই হল থেকে বের করে দিতে। ওই প্রাধ্যক্ষ করলেনও তাই। যিনি ওই আবাসিক ভবনের প্রধান, যার কাছে মা-বাবারা ভরসা করে সন্তান রেখে যান, তিনি ছাত্রলীগের নিম্নসারির একজন নেতার কথাও ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। 

আমরা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই, যখন শুনি, হলের প্রাধ্যক্ষ যিনি একজন সিনিয়র অধ্যাপক এবং আগে হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, তার অফিস কক্ষে কোনো বিশেষ ছাত্র সংগঠনের নেতা প্রবেশ করলে তিনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। দুই দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রক্টর অফিসে গেলে একজন সহকারী প্রক্টর চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। এই যোগ্যতায় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অধ্যাপক ও পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন।
 
প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো এভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন দায়িত্বশীলরা? ওই সময়ের কিন্তু এমন অনেক শিক্ষক এখনও বেঁচে আছেন, যাদের দেখলে সবাই সমীহ করেন, শিক্ষককে শিক্ষকের মতোই মান্য করেন। 

এই দুই শ্রেণির শিক্ষকের মধ্যে আরো পার্থক্য তৈরি হয়েছে দিনে দিনে। যেমন ধরুন, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে খালি জায়গা দেখে ছাত্রনেতা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এখানে একটা ভবন নির্মান করতে হবে, মানে নতুন প্রজেক্ট আনতে হবে। সেটা হতে পারে নতুন লাইব্রেরি ভবন, মিলনায়তন, কোনো অনুষদের নতুন ভবন। এটা এখন আর অধ্যক্ষ বা উপাচার্যের মাথায় আসতে হয় না। আসে ছাত্রনেতার মাথায়। তিনি এটা চাপিয়ে দেন ভিসি বা প্রিন্সিপালের মাথায়। জানান, এভাবে এভাবে প্রজেক্ট করবেন স্যার। আমরা এটা পাস করার ব্যাপারে আপনাকে হেল্প করবো। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে সেই মতো কাজ করতে হয়। ঢাকায় গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর ইউজিসিতে ঘুরতে হয়। সেখানে ছাত্রনেতারা তাদের নেতাদের দিয়ে কাজ এগিয়ে রাখেন। ভবনের কাজ শুরু হয় এক সময়। 

আবার ধরুন, উপজেলা শিক্ষা অফিসার পৌঁছানোর আগে, স্থানীয় জননেতা প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা কখনো নিয়ে ফেলেন। শিক্ষা অফিসার স্কুলে পৌঁছে দেখলেন সব শেষ, খাওয়া-দাওয়া চলছে। তাকে বলা হলো, পরীক্ষা হয়ে গেছে। খামের ভেতরের কাগজে নতুন বা হবু শিক্ষকদের নাম লেখা আছে। প্রাথমিকের এই শিক্ষক ৩৫ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের কী পড়াবেন বা পড়াতে পারবেন, এটা কে ভাববেন? 

অথচ এখনো এমন শিক্ষক প্রশাসক আছেন যার কক্ষে ঢোকার আগে ছাত্রনেতাকে ৫ মিনিট হলেও বাইরে বসতে হয়। যদিও এই সংখ্যা শত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হাতে গোণার চেয়েও কম হতে পারে। তবুওতো প্রদীপ জ্বলে আছে। 

তাহলে কেনো এই আত্মসমর্পণ! কেনো যিনি বা যারা ছাত্র্রকে দেখে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, টিকে থাকতে ছাত্রের প্রয়োজনে প্রজেক্ট করছেন? কারণ তিনি বা তারা যে পদের যোগ্য নন, সে পদে ভিন্ন উপায়ে বসে পড়েছেন। আর যাদের বসার কথা ছিলো, দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিলো, তারা উপেক্ষিত থেকেছেন। 

পেশাগত কারণে ২৫ বছর ধরে শিক্ষার দিকে দৃষ্টি ছিলো আমাদের অনেকের। সেই দৃষ্টি ঝাপসা হবার পথে। ভিসির ভবনে না থেকে যে বাসায় ভাড়া থেকেছেন সেটা সেটা যে আপনার শ্বশুরের বাড়ি ছিলো ৫ বা ১০ বছর পর জানাজানি হলেও তো বিষয়টা কেমন! গেলেন গাড়িতে, তুলে নিলেন প্লেনে যাতায়াতের ভাড়া, কেনো হয় এটা? 

প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ প্রাপ্তির সাথে থাকে সমাজের সম্মান আর মর‌্যাদার আকাঙ্ক্ষা। বছর কয়েক পার হলে সেখানে ঢুকে পড়ে আপনার অফিসের গাড়ির তেলের পরিমাণের প্রকৃত আর বিকৃত হিসেবের খবর। কিন্তু, অতীতে যে শেষমেষ সবই বের হয়ে এসেছিলো, সেটা মনে রাখবেন।

যে বা যারা এসবের মধ্যে দিয়ে গেছেন বা যান তাদের মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষ কিন্তু এসব জানে। এসব তারা ভুলতে পারেন না, কষ্ট পান। নিয়োগ কর্তাও প্রতারিত হন। যারা এই নোংরাপথে হাঁটেন শেষ বয়সে কী অর্জন তাদের? হিসেব করলে সেই হিসেব আসলে কতোটুকু মেলে।

 লেখক : বোরহানুল হক সম্রাট, সাংবাদিক 

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051431655883789