পশ্চিমবঙ্গে সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলে শিক্ষা সংক্রান্ত সংবাদ সর্বাধিক পরিবেশিত হয়। আর সে সবই মামলা সংক্রান্ত। মনে হয়, বাংলায় শিক্ষা স্তব্ধ, থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি এবং কলহে শিক্ষা শেষ। এখন নৈরাজ্যের পালা। এই সব খবরের মাঝে শিক্ষার যে আরও অনেক দিক আছে, সে সম্পর্কে হয় আমরা বিস্মৃত অথবা উদাসীন।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের ২০২৩-এ প্রকাশিত শিক্ষানীতির কিছু দিক নজর কাড়ে। এই রিপোর্টে পূর্বতন রিপোর্টগুলোর উচ্চভাষা নেই, উচ্চমার্গের ছাপ নেই। এমনকি পূর্বতন ওই রিপোর্টগুলোতে প্রকাশিত নীতিসমূহ এবং প্রস্তাবিত পথের কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে বা হয়নি, এবং কেন এই নতুন নীতি প্রকাশ করা প্রয়োজন ছিলো, সে নিয়ে কোনো মুখবন্ধ নেই। কী দরকার, কী আছে, কোথায় ফাঁক, কোথায় গাফিলতি, আর প্রশাসনের ইচ্ছা কী শিক্ষার অগ্রগতি সম্পর্কে, তার এক ব্যবহারিক বিবরণ। যেনো যে শ্রেণি ও সমাজের সমর্থনে এই সরকার ক্ষমতাসীন, তারা যেভাবে শিক্ষাকে দেখে, তার এক প্রতিচ্ছবি। শিক্ষা নয়, ট্রেনিং চাই, যাতে বাঁচা যায়, দুটো খেতে পাওয়া যায়, কাজ পাওয়া যায়।
জনবাদী শিক্ষানীতির এই রিপোর্টে বলা আছে, বিদ্যালয়ে তিন ভাষা নীতি, উচ্চ শ্রেণির বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়সাধন, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে ভারসাম্য আনতে শিক্ষক-সংখ্যায় পরিবর্তন, অনুরূপ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পরিকাঠামোসমূহের সমন্বিত ব্যবহারের ব্যবস্থা, তেমনই উচ্চতর স্তরে চিকিৎসাশাস্ত্রের উপযোগী, বা প্রযুক্তিবিদ্যার উপযুক্ত শিক্ষা উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শুরু করা, ইত্যাদি।
উল্লেখ রয়েছে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ অংশগুলোতে উপযুক্ত বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ব্যবস্থারও। সবাই জানেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ও অনুন্নত গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল আছে তো শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছেন তো স্কুল নেই। কোথাও বিজ্ঞান শিক্ষক নেই, অথচ কলা বিভাগীয় বিষয়ের শিক্ষকের সংখ্যা প্রয়োজনাতিরিক্ত। পরিকাঠামোর পরিকল্পনা এবং সম্পদ ব্যবহারে সামঞ্জস্যের প্রয়োজনীয়তা সরকারি এই রিপোর্টেও আছে, কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপের উল্লেখ এখানে নেই।
এই সব উদ্যোগের ভাবনা কি ভাবনার স্তরেই থেকে যাবে? প্রাত্যহিকতার থেকে অন্তত আংশিক মুক্তি অর্জন করে পরিকল্পনার দিকে জনবাদী প্রশাসন কি যেতে পারবে? এই রিপোর্ট পড়ে বার বার এই প্রশ্ন মনে জেগেছে। জনবাদী ভাবনায় নানা নতুন সৃজনশীল চিন্তার উপাদান থাকে। যে দৃঢ়তা, সঙ্ঘবদ্ধ পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রয়োজন। জনবাদী প্রশাসন কি সেগুলোর সমাহারে এবং কার্যকর করার পথে সক্ষম হবে, সে বিষয়ে প্রশাসনকেই ভাবতে হবে। সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার কথা বার বার এসেছে এই প্রতিবেদনে। এর চেয়ে ভাল কথা হতে পারে না। কিন্তু সম্পদ মানেই তো ঘুঘুর বাসা। তাতে হাত দেওয়ার দৃঢ়তা জনবাদী প্রশাসন দেখাতে পারবে? প্রশাসন দক্ষতা শিক্ষণের কথা বলেছে, ছেলেমেয়েরা যাতে কাজ পায় বা স্বনির্ভর পেশায় যুক্ত হতে পারে। এখানেও বিশদ ভাবার প্রয়োজন আছে। কম আয়ে, কম রসদে কী ভাবে এই সব উদ্যোগ করা যায়? কোভিড অতিমারি বাংলার শিক্ষায় এক বিপর্যয় এনেছে। কিন্তু এ নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবনা, গবেষণা, নিদেনপক্ষে তথ্য সংগ্রহ, এবং নতুন উদ্যোগ কোথায়?
২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২, এই দশ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয় চারশোর মতো বেড়েছে, তুলনায় উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় বেড়েছে প্রায় আটশো, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমেছে, অন্য দিকে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। হয়তো মাধ্যমিক বিদ্যালয় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। তাই এই রকমফের। সামগ্রিকভাবে বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৬০ হাজার ৮৭৩ থেকে ৬৩ হাজার ৮৪০। দশ বছরে তিন হাজার নতুন স্কুল। ২০৩০-এর আগে যদি একশো শতাংশ সাক্ষরতা অর্জন করতে হয়, তবে এই প্রগতি কি যথেষ্ট?
কোভিড সম্ভবত আঞ্চলিক বৈষম্য আরও বাড়িয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় এই দশ বছরে বেড়েছে নব্বইটা। কিন্তু ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা কমেছে। ২০১১-১২’য় এই সংখ্যা ছিলো ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৮, ২০২১-২২’এ এই মোট সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৮। প্রাথমিক স্তরে ড্রপ আউটের শতকরা ভাগ বেড়েছে। আগে ছিল ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ২০২১-২২’এ ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। চা বাগান অঞ্চলে এই তারতম্য আরও প্রকট। ২০১১-১২’য় মোট ভর্তির সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৭। দশ বছর বাদে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ২৯ হাজার ৯৭০। কিন্তু ড্রপ আউটের ক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতি চোখে পড়ার মতো। ২০১১-১২ ছিলো প্রাথমিক স্তরে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। দশ বছর পরে সেই শতকরা হিসাব নেমেছে শূন্যে। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে ২১ দশমিক ২৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
কলকাতায় পড়াশোনার জন্য ঘর দরকার ৪৫১। পূর্ব মেদিনীপুরে ২ হাজার ২৫৭। পুরুলিয়ায় ৩ হাজার ৬১৪। মুর্শিদাবাদে ৭ হাজার ৩৬। আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতার এ ধরনের উদাহরণ সরকারি রিপোর্টে আরও আছে। তেমনই কলকাতায় কলেজের সংখ্যা ৬০। পুরুলিয়ায় ৬। এই ভারসাম্যহীনতার কারণ সহজবোধ্য। তা ছাড়া জনঘনত্বের প্রয়োজনের কথাও খেয়াল রাখা দরকার। তবু পশ্চিমবঙ্গে এক ভারসাম্যবিশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে, আশু দৃষ্টির দাবি রাখে। কোভিডের ধাক্কা সামলে এগোতে হলে দৈনন্দিন উন্নয়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে পরিকল্পনাকে যুক্ত করা চাই। সহজাত, শ্রেণিগত তাৎক্ষণিকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন রাজ্যব্যাপী শিক্ষা প্রসারের দৃঢ় পরিকল্পনা। এবং শিক্ষার জন্য উন্মাদনা।
বাংলায় উচ্চশিক্ষা প্রসারের হাল কী রকম? ২০১১-য় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৬। দশ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৮। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে ১২ থেকে ৩১-এ। সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ৪৬৫ থেকে ৫১৭। মোট ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে ১৪ লাখ থেকে ২৮ লাখে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকারের ক্রেডিট কার্ড ব্যবস্থা। অত্যন্ত স্বল্প ঋণে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পড়াশোনা চালানোর জন্য ঋণ। সরকার এই ঋণের ব্যবস্থা করবে। এই ব্যবস্থায় ৫৫ শতাংশ উপভোক্তা নারী, ৪৫ শতাংশ পুরুষ। ১ লাখ টাকার কম মাসিক পারিবারিক আয় যে পরিবারগুলোর, তারাই এই ব্যবস্থার সিংহভাগ উপকার পেয়েছে।
সরকারি আর্থিক ও সামাজিক সহায়তার ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা যেটুকু ঘটছে, তার গুণগত মান কীভাবে অর্জন করা যাবে? তামিলনাড়ুতে উচ্চমান সম্পন্ন কলেজের সংখ্যা ১৪০, পশ্চিমবঙ্গে ৪৩। তেলঙ্গানায় ৬১। অতি উচ্চমানের কলেজ তামিলনাড়ুতে ৫০, পশ্চিমবঙ্গে ২, তেলঙ্গানায় ২০। উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যথাক্রমে ১১, ৭, এবং ৮। এবং অতি অতি উচ্চমান সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তামিলনাড়ুতে ৯, পশ্চিমবঙ্গে ১। গুণগত মানের ক্ষেত্রে বাংলার এই পিছিয়ে থাকা অবস্থা কাটবে কী করে? সাধারণ দৈনন্দিন কর্মসূচি কি এর জন্য যথেষ্ট? শিক্ষার পলিসি সংক্রান্ত এই রিপোর্টে সে প্রশ্নের সদুত্তর নেই।
যদি গবেষণার উন্নতি এর সদুত্তর হয়, তাহলে এ নিয়ে ভাবনার কোনো বিশেষ ছাপ এই প্রতিবেদনে নেই। বলা আছে, কিছু সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের কথা। এর বাইরে কাঠামোগত সংস্কার বা উদ্ভাবনের কথা নেই। আর্থিক অনটন সত্যি কথা। কিন্তু স্বদেশি যুগে জ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে গবেষণা এবং উচ্চমানের কাজ সম্ভব হয়েছিল কীভাবে? উচ্চমান সম্পন্ন গবেষণার রহস্য কী? শুধুই অর্থ?
এ ব্যাপারে আমেরিকান মডেল আছে, অন্য ধরনের অভিজ্ঞতাও আছে। সরকারি রিপোর্টে একটা উপলব্ধি বার বার এসেছে। বিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার এক আন্তঃসম্পর্কযুক্ত, বলা চলে সংহত রূপ চাই। এরও জন্য দরকার পরিকল্পনা।
তামিলনাড়ু এগিয়েছে কীভাবে? অন্যতম বড় কারণ— তামিল জনবাদী রাজনীতি ও আন্দোলনের ব্যাপক সামাজিক ভিত্তি। সামাজিক ন্যায়ের জন্য আন্দোলন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী জনভিত্তিকে শক্ত করেছে, সমগ্র রাজ্য জুড়ে গণশিক্ষার ভিত্তিকে শক্ত করেছে। বেসরকারি পুঁজি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এসেছে। কেরালা থেকেও শেখার আছে। বাংলার জন্য দরদ ছাড়া, বাংলাকে জানার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছাড়া বাংলায় শিক্ষার অগ্রগতি হবে কী করে? বাংলায় সামাজিক ন্যায় ও গণতন্ত্রকে প্রসারিত করা জনবাদী রাজনীতির প্রধানতম চ্যালেঞ্জ এবং কর্তব্য।
শিক্ষার উন্নতির চাবিকাঠি এই কর্তব্যের মধ্যেই নিহিত। শিক্ষা প্রসারের জন্য জনতদারকি দরকার। শুধু পর্ষদ গঠন এই তদারকি হবে না, শিক্ষা আসবে জনসচেতনতার অগ্রগতির হাত ধরে। গত শতাব্দীর এক মহানায়ক বলেছিলেন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। অল্প করো, কিন্তু ভাল করে করো।
সূত্র: আনন্দবাজার