দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার ঘটনায় এখনো দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছেন। মি. আজীমের মরদেহের সন্ধান ও হত্যার কারণ জানতে উভয় দেশের কর্মকর্তারা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছেন। মঙ্গলবার (২৮ মে) বিবিসি বাংলা অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, আসামিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ভিত্তিতে নিহতের লাশ খুঁজে পেতে কয়েকদফা অনুসন্ধানও চলেছে।
তবে, প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের নাগরিক একজন এমপিকে ভারতে হত্যার ঘটনায় বিচার হবে কোন দেশে? কারণ হত্যা সংঘটনের স্থান ভারতের কলকাতায় হলেও এর পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগী, আসামি, ঘটনাস্থল এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বিবেচনায় দুই দেশেরই এই হত্যা মামলার বিচার করার এখতিয়ার রয়েছে।
এ বিষয়ে একাধিক মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ও রয়েছে।
যা বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা
দুই দেশেরই ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, সাধারণত অপরাধ সংঘটনের স্থানে মামলার বিচার হয়।
তবে, এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার যে ধরন তাতে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মামলার বিচার দুই দেশেই সম্ভব বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, “এই সুনির্দিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিচার করার দাবিটা করতে পারে। কারণ বাংলাদেশের ভিকটিম, আসামি, মেইন কজ অব একশন বাংলাদেশেই উদ্ভূত হয়েছে। শুধুমাত্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ভারতে। অর্থাৎ ঘটনা পরিণতি লাভ করেছে ভারতে।”
সুতরাং বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবেই এই অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে পারবে বলে মনে করছেন তাপস কান্তি।
এছাড়া ও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কোনো ধরনের অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তার লক্ষ্যে রয়েছে একটি চুক্তি। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশই করতে পারে এই হত্যা মামলার বিচার।
বাংলাদেশে ২০১২ সালে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্স ইন ক্রিমিনাল ম্যাটারস অ্যাক্ট” নামে একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর অধীনে একটি নীতিমালা ও করা হয়।
এছাড়া ভারতের সাথে বাংলাদেশের এই আইনের অধীনে আন্তর্জাতিক কনভেনশনও আছে। দুই দেশই এতে স্বাক্ষর করেছে।
একইসাথে এই কনভেনশনের অধীনে ২০১৩ সালে দুই দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
ওই চুক্তির ফলে ভারতের কোনো নাগরিক যদি বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করে বা শিকার হয় সেক্ষেত্রে ভারতেও এর বিচার হতে পারে।
সেক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের শারীরিক বা দালিলিক প্রমাণ, অভিযোগপত্র বা কোনো সাক্ষ্য এমনকি মৌখিক সাক্ষ্যও দেয়ার প্রয়োজন হলে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করতে পারবে।
একইসাথে, যদি বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতে কোনো অপরাধ করে বা শিকার হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মামলা করতে পারবে। এক্ষেত্রে যেসব দালিলিক বা বস্তুগত প্রমাণ আছে তা তাদের কাছে চাইতে পারবে বাংলাদেশ।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তাপস কান্তি বলেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন, সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ, বস্তুগত যেসব প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। এই চুক্তির অধীনে ভারত এসব দিতে পারবে।”
চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার প্রয়োজন হলে ভারত থেকে আসতে পারবে সাক্ষীরা। মামলার সাক্ষী হিসেবে আলামত জব্দকারী কর্মকর্তা, তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অথবা বিচারের স্বার্থে যাদের সাক্ষ্য দেয়া প্রয়োজন তারা বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারবে।
“তবে, কোনো কারণে সাক্ষীরা বাংলাদেশে আসতে না পারলে ভার্চুয়ালিও সাক্ষ্য নেয়া যাবে। কারণ এখন বাংলাদেশ এভিডেন্স অ্যাক্ট পরিমার্জন করে ডিজিটালিও সাক্ষ্য নিচ্ছে। ফলে অনলাইনেও সাক্ষ্য নেয়া যাবে,” বলেন তাপস কান্তি।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা ও কলকাতা দুই স্থানেই মামলা হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশেই দুই-তিন মাস আগে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান এ হত্যার পরিকল্পনা করে। যেহেতু আজীম কলকাতায় যাবেন তাই সেখানেই খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। এই আখতারুজ্জামান শাহীন মার্কিন নাগরিক এবং একইসাথে আজীমের ব্যবসায়িক অংশীদার বলে জানিয়েছিলেন রশীদ।
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুই দেশে দুই ধরনের অপরাধের বিচার করলে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা সহজ হবে। যদি মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় তাহলে বাংলাদেশ তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।”
“কারণ আমাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। কিন্তু ভারত তাকে সে দেশে ফেরাতে পারবে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে,” বলেন শামসুদ্দিন ।
এর আগে, কলকাতা হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ ফৌজদারি আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চ্যাটার্জী বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “অপরাধ যেহেতু ভারতে হয়েছে, তাই এদেশের আইন অনুযায়ীই বিচার হওয়ার কথা।”
“সে ক্ষেত্রে বিচারটা কোন দেশে হবে, তা দু'দেশের মধ্যে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে,” বলেছেন জয়ন্ত নারায়ণ।
ঘটনার পূর্বাপর
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদ হাওলাদার কলকাতা সিআইডির জেরার মুখে জানিয়েছে আজিমকে হত্যার পরে তার শরীর থেকে মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল। তারপর সেটিকে টুকরো করে ফেলেছিল সে।
লাগাতার জেরায় জিহাদ এখন তদন্তকারীদের বলেছে যে হাড় এবং খুলির টুকরো সে-ই আলাদা করেছিল, কিন্ত তা কোথাও ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আরেক অভিযুক্ত ফয়সালের ওপরে।
আজীমের শরীরের মাংসের টুকরোগুলি কোথায় ফেলেছিল জিহাদ, সেটা সে সিআইডির তদন্তকারীদের দেখিয়েছে। কিন্তু ফয়সাল কোথায় খুলি আর হাড়ের টুকরোগুলি ফেলেছে, তা সে জানে না বলেই এখনও পর্যন্ত জেরায় দাবি করেছে জিহাদ।
তবে নিউ টাউন সংলগ্ন ভাঙ্গর এলাকার কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে যে জায়গায় বাগজোলা খালে সংসদ সদস্যের শরীরের মাংসের টুকরোগুলি ফেলেছিল বলে জিহাদ দেখিয়ে দিয়েছিল, সেখানে রবিবার চতুর্থ দিনের মতো ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালানো হলেও কিছুই উদ্ধার করা যায়নি।
বাংলাদেশ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রশীদের নেতৃত্বে যে দলটি কলকাতায় যায় তারা সিআইডির তদন্তকারীদের সঙ্গে নিউ টাউন থানা থেকে সঞ্জীভা গার্ডেন্সের যে ফ্ল্যাটে আজীমকে হত্যা করা হয়েছে সেটি পরিদর্শন করেছে।
রশীদ গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, দুই তিন মাস আগে বাংলাদেশে বসেই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়।
গত ১২ই মে এমপি আজীম কলকাতায় গিয়ে সেখানকার গয়না ব্যবসায়ী বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন।
এর আগে গোপাল বিশ্বাস বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ১৩ই মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আজীম।
পরে তিনি জিডি করেন থানায়। এরই প্রেক্ষিতে যে ট্যাক্সিতে করে আজীম সেখান থেকে যান তার চালককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরে সিসিটিভির ফুটেজও উদ্ধার করা হয়।