স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বছরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেশটিতে একটি বিশেষ শ্রেণিকে আজো লালন পালন করে সমাজে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে এই লজ্জা দেশের না কি এই দেশে জন্ম নেয়া দুর্ভাগা মেধাবীদের তা আমার বোধগম্য নয়।
এই পোষ্য তথা পালিত পদ্ধতির ইতিহাসটা একটু দেখে নেয়া যাক। ইতিহাস ঘেঁটে যতো দূর জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে কোটা চালু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন মুক্তিযুদ্ধাদের বিশেষ সম্মানার্থেই এই কোটাটি চালু করেছিলেন তিনি। তখন সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মেধা কোটা ছিলো ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ৪০ শতাংশ জেলা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ শতাংশ ছিলো যুদ্ধাহত নারী কোটা। ১৯৭৫’র পরিবর্তন আসে কোটায়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০ শতাংশ, জেলা কোটায় ২০ শতাংশ ও আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা হয় ৩০ শতাংশ।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আবারও পরিবর্তন আনা হয় কোটা ব্যবস্থায়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ, জেলা কোটায় ১০ শতাংশ ও নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয় ৫ শতাংশ কোটা।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বিশেষ সম্মাননা হিসেবে আবার কোটা চালু করেন। আর সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটা পদ্ধতি তো চালু আছেই। সবশেষ ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর জেলাভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে কোটার প্রচলন প্রথম শুরু হয় ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে। সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ভারতীয়দের জন্য আলাদা কোটার ব্যবস্থা করা হয় তখন থেকে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলমানদের জন্যও আলাদা কোটা রাখা হয়। পাকিস্তান আমলে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মানুষদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চালু করা হয় প্রদেশ ভিত্তিক কোটা। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন সচিবের এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বাংলাদেশে। বর্তমানে দেশে প্রথম শ্রেণির চাকরি থেকে শুরু করে সকল কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধার ছেলে ও মেয়ে, নাতি-নাতনি কোটা, জেলা কোটা, উপজাতি কোটা, পোষ্য কোটা, নারী কোটাসহ বিভিন্ন কোটা বিদ্যমান।
এই হচ্ছে কোটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সেদিন নিজের চিকৎসার জন্য ওসমানী হাসপাতালে গেলাম এক্সরে রিপোর্ট আনতে। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়েও দেখলাম বিশেষ কোটাভিত্তিক লাইন। মাত্র দুজনের লাইন। দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমার সুরাহা নাহলেও ওরা ঠিকই এক ঘণ্টা পরে এসেও ৫ মিনিটেই রিপোর্ট নিয়ে চলে গেলো, শুধুই দেখলাম আর নির্বাক মনে নিজেকে বুঝ দিলাম এই ভেবে যে কোটাযুক্ত দেশে যতোটুকু আছি এমন ভালো থাকাটাই তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমিতো নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান এই দেশে জন্মে।
ওপরের কোটা প্রেক্ষিত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধরুন, আপনার সন্তানকে বারবার হাত ধরে হাঁটা শেখাচ্ছেন। তার পরেও হাঁটা না শেখায় বাঁচ্চার জন্য একজন মানুষ রেখেছেন তাকে হাঁটানোর জন্য। এটা আপনার দায়িত্ব। ঠিক সেটাই ছিলো মুলত কোটা ব্যবস্থা। সেটাই করে গিয়েছিলেন আমাদের প্রয়াত মহান স্থপতি জাতির পিতা। কিন্তু এইভাবে যদি ১০ বছরেও বাচ্চাটি হাঁটতে না শেখে তাহলে বুঝে নিতে হবে এই বাচ্চার হাঁটার ইচ্ছেই নেই অতএব তাকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করলেই উত্তম। আর দীর্ঘমেয়াদি হেল্পের কারণে সে ভাবতে শিখেছে যে একজন লোক নিয়ত তাকে হাত ধরে হাঁটাবেই এটা তার অধিকার এবং এটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। তাই কোনো সময় কেউ এসে তাকে হেল্প না করলে সে চেঁচিয়ে উঠে। ঠিক তেমনি আগে কোটা করে অনগ্রসরদের অগ্রাধিকার দেয়া যুক্তিযুক্ত হলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে কোটা রাখা অনেকটা সেই পালিত বাচ্চার মতোই হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ওদের আর অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছেটাই নেই। ওরা কখনোই তো দাঁড়াতে শিখবেই না বরং যখনই একটু সুযোগ হারাচ্ছে তখনই তারা ওই বাচ্চা ছেলের মতই চেঁচামেচি করছে যা বিগত কয়েক বছর আগে প্রাথমিকের ফল নিয়ে রিট করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত। অনগ্রসর জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ নজর নিঃসন্দেহে সরকারের প্রসংশনীয় উদ্যোগ। তবে সেটা কি কেবল চাকরি দিয়েই বাস্তবায়ন করতে হবে? সরকার চাইলে ওদেরকে বিনা শ্রমে স্বল্প শ্রমের কোনো কাজ দিয়েও তো বেতন দিতে পারেন তাহলে তো ওদের সম্মান আরো বাড়বে। তা ছাড়া কাজ করিয়ে বেতন দিয়ে এমন কি ক্রেডিট রয়েছে যে ওদেরকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে? অপরদিকে, অফিস আদালতে যোগ্য ব্যক্তির দরকার হয়, শিক্ষকতায় যোগ্য ব্যক্তির দরকার হয়, সেখানে বিশেষ সুবিধা দিয়ে অযোগ্যদের পদায়ন করা মেধাবীদের সঙ্গে রীতিমত মশকরা নয় কি? তাহলে রাত-দিন খাটুনি করে পড়ালেখা করার কি-ই বা অর্থ থাকলো। আর এভাবে হতাশ হয়ে অনেক মেধাবীর অপমৃত্যু হচ্ছে যা নতুন মেধাবী সৃষ্টির অন্তরায়! বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণীজনের কদর নেই, সেদেশে গুণীজন জন্মায় না’ তাহলে আমরা তো ঠিক সেদিকেই যাচ্ছি। সময় থাকতে বিষয়গুলো ভাবতে হবে নতুবা অসময়ে পস্তাতে হবে। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে সম্মানিত করতে কি চাকরিটাই যথেষ্ট? যারা জীবন ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে এই দেশটা স্বাধীন করেছেন তারা তো এদেশের মালিক, ওনাদের সন্তানরা তো দেশের মালিক পক্ষ। তাই মালিকদের কি সাধারণের সঙ্গে এসে মজুরিভুক্ত হওয়াটা খুব বেশি সম্মানের? তার চেয়ে বরং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতিটি সন্তানের জন্য বিনাশ্রমে একটি স্ট্যন্ডার্ড মানের ভাতা দিয়ে দিলে কি দেশের খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? বরং মেধাবীরা দেশ চালালে দেশ দ্রুত উন্নতির শিখরে যাবে। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ও তাদের উত্তরসূরীদের বীরের মতোই এদেশে রাখা যাবে, চাকরির নামে চাকরের মতো সুযোগ দেয়াটা কি খুব বেশি সম্মানের? সময় এসেছে এখন এগুলো ভাবার, পর্যালোচনার।
একটা সময় ছিলো মানুষ কোনো কিছু উপরন্তু পাওনাকে ‘করুণা’ হিসেবে দেখতো। কারো থেকে কিছু নেয়াকে নিজের অসহায়ত্ব মনে করতো। আজকাল আর তা মনে হয় না। জাতি হিসেবে আমরা আজ নির্লজ্জের স্বর্গভূমের দিকেই যাচ্ছি দিন দিন। করুণায় কিছু পাওয়াকে আমরা এখন আর দান হিসেবে দেখি না বরং অধিকার হিসেবেই দেখি। ভিক্ষুকও এখন দুটাকা পাওয়াকে করুণা মনে করে না বরং দুটাকা তো দূরের কথা ন্যূনতম ৫ টাকা না দিলে হাতেই নেয় না। আরো বেশি চায়। মনে হয় ভিক্ষায় কিছু পাওয়াটা তার জন্মে জন্মান্তরের অধিকার। আর এই কোটা এখন হয়ে উঠেছে এক ভয়ংকর হাতিয়ার। দেশের উচ্চ পর্যায়গুলোতে প্রায় সব চেয়ারেই কোটাধারীরা ঘাঁপটি মেরে বসে আছে। যে কারণে চাকরির পরীক্ষায় এমসিকিউতে দেখবেন এমন সব প্রশ্ন করে যেগুলো বারবার আসছে, খুবই সহজ প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো দেখে একজন সরলমনা শিক্ষার্থী খুব খুশিতে উদ্বেলিত হতে পারেন। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আসলে এটি করা হয় মূলত তাদের উত্তরসূরি কোটাধারীদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে তুলে আনার একটি নীল নঁকশা মাত্র। সহজ প্রশ্নে ভাইভা পর্যন্ত তাদের সন্তান, নাতি, পুতিদের কোয়ালিফাই করতে পারলেই বাকি কাজটা তো তারাই ফিনিস করবে? বাহ দারুণ এক আবিষ্কার। আর দিনের পর দিন মেধাবীরা কোটার কাছে মার খেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অপরদিকে মেধাহীনরা দেশ পরিচালনা করা কুফল আমরা পেতে শুরু করেছি।
আর একটা বিশেষ শ্রেণি সম্পর্কে দুএকটা কথা না বলেও পারছি না। এই শ্রেণিটা সমান অধিকারের জন্য সারা জনম আন্দোলন করলেও অদ্ভুত ব্যাপার স্বার্থের বেলায় তারা বেশি অধিকার না পেলে, অন্যের সমান হলেও তারা আবার ক্ষেপে যান। সত্যি সেলুকাস! ছাত্রজীবন থেকে এই সার্কাস দেখতে দেখতে এখন আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। কবে আপনারা নিজেকে বুদ্ধিতে, জ্ঞানে অন্যদের সমান মনে করবেন নাকি এভাবেই নিজেকে ধন্য মনে করেন জানি না। নিজেকে সমাজের বিশেষায়িত প্রাণী না ভেবে অন্যদের মতোই ভাবুন তাহলে নিজেও উন্নতি করবেন, নিজের বংশধররাও উন্নতি করতে পারবে।
এটা কী ধরনের মানসিকতা,আমি উচ্চ পর্যায়ের চাকরি করলেই আমার সন্তানকে বিশেষায়িতভাবে উচ্চ চেয়ারে বসাতে হবে? তাহলে ওই চেয়ারে বসতে যে কঠোর রাস্তা পাড়ি দিতে হয় তার কি মর্যাদা থাকলো? তা ছাড়া চেয়ারের মর্যাদা, উপযুক্ততা সেটা কি ওই বিশেষায়িত অযোগ্য ব্যক্তি বুঝবেন? আরে ভাই কোটা নেবেন আর নিজের অযোগ্যতাটি আপনি স্বীকার করবেন না এটা কি ধরনের মানসিকতা? এটা কি ধরনের মনোভাব আপনার?
আমি কোনো চাকরি প্রার্থী নই। তার পরও আজকের এই অত্যাধুনিক যুগে আমার চাওয়া আগামী প্রজন্ম কোটা মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তি পাক, মুক্তি পাক কোটার অভিশাপ থেকে, জয় জয়কার হোক মেধাবীদের। রইলাম কোটামুক্ত জন্মভুমির অপেক্ষায়। সংশ্লিষ্টদের কাছে আমার জোর অনুরোধ, মেধাবীরা যেনো দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। অপরদিকে, কোনো অপকৌশলে মেধাহীনরা যেনো দেশ পরিচানায় না আসতে পারেন তার জন্য সর্বনাশী কোটা প্রথা থেকে দ্রুত জাতিকে পরিত্রাণ দেবেন।
লেখক: সভাপতি, হাওর সাহিত্য উন্নয় সংস্থা