অর্থ ও অর্থনীতি দুটিই আমার কাছে জটিল মনে হয়। তাই বাজেটের মারপ্যাঁচ বোঝা আমার কর্ম নয়। রাজনীতির অঙ্গনে বিএনপির মতো সরকারবিরোধী দল আর আমার মধ্যে একটি মিল আছে। আমাদের দেশের বিরোধী দলের বাজেট না বুঝলেও চলে। শনিবার (২৭ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরো জানা যায়, বাজেট পেশের পরপরই তারা ‘এটি সরকারের মানুষ মারার বাজেট’ বলে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে। বাজেট পড়া বা বোঝার দরকার পড়ে না এ ধারার রাজনীতিকদের। শুনে মনে হয় বাজেট পেশের আগেই গত্বাঁধা প্রতিক্রিয়া লেখা থাকে। আমার দশা অনেকটা এ রকমই।
তবে প্রকৃতিতে পার্থক্য রয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। বাজেট ঘোষণার পর হয়তো বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। এসব গা সওয়া।
হয়তো ইনকাম ট্যাক্স আরো পাঁচ বা ১০ হাজার টাকা বেশি দিতে হবে। এসব গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি সব সময় থাকে। বিরোধী দল যেমন বাজেট না পড়েই (আমার বিশ্বাস) প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, তেমনি আমি বুঝব না মনে করে না পড়েই নিশ্চিন্তে থাকার চেষ্টা করি। তবে পেশার কারণে শিক্ষাঙ্গনের ভালো-মন্দ তো আর চোখ এড়ায় না। বাজেট না পড়লে বা না জানলেও এর প্রভাব শিক্ষাঙ্গনে অনুভব করতে পারি।
বছরের পর বছর বাজেটের পর শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক ও ছাত্রদের একাডেমিক এবং জাগতিক উন্নতি-অবনতি দেখে বাজেটের প্রভাব বোঝা সম্ভব। এ কারণে বাজেটে কত হাজার কোটি টাকা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলো, তা জানার কৌতূহল কখনো তৈরি হয় না। প্রায় প্রতি বাজেটেই শুনি শিক্ষা খাতে অনেক বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাজেটের পর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত কিছু উন্নতি চোখে পড়লেও শিক্ষা সরঞ্জাম এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর তেমন উন্নতি বড় দাগে চোখে পড়ে না। তাই প্রশ্ন জাগে, কোথায় চলে যায় শিক্ষা বাজেটের এত এত বরাদ্দ?
শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বরাবরই বলি প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে গোটা স্কুল শিক্ষা শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে শিক্ষার্থীর একাডেমিক ভিত্তি তৈরি হয়। তাই পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয় স্কুল শিক্ষা অঞ্চলের প্রতি। এ পর্যায়ে থাকা উচিত অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণ সমৃদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাস্তবসম্মত এবং জ্ঞান উদ্দীপক আনন্দময় পাঠ উপযোগী কারিকুলাম তৈরি। আর এসব যথার্থভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ, যোগ্য মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তেমন মেধাবী আকৃষ্ট হবে কেন! পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলাম পশ্চিমবঙ্গের দিকেও যদি তাকাই, তাহলে বাস্তবতা অনুভব করব। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গ্র্যাজুয়েট নন, এখানে অনেক পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়া ব্যক্তিও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে সন্তুষ্ট। তাঁদের বেতনকাঠামো যথেষ্ট সম্মানজনক। বেতনকাঠামোর সঙ্গে সামাজিক মর্যাদারও অলিখিত সম্পর্ক থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সমাজের ব্রাত্যজন। শহরাঞ্চল বাদ দিলে মফস্বল আর গ্রামের স্কুলের অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণের জায়গাটি এখনো দুর্বল। শিক্ষকদের বেতনকাঠামো নিয়ে সরকারি আত্মতৃপ্তি রয়েছে। সব সরকারি চাকুরের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেখানে বেতন থাকার কথা ছিল ১০ টাকা, তা বেড়ে ২০ টাকা হলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু বরাবর শিক্ষকের বেতন ১০-এর বদলে যখন দুই টাকা থাকে, তা বেড়ে চার টাকা হলে এই বাজারে বা সমাজে তার অবস্থার কী এমন রূপান্তর ঘটল!
এ দেশে যেন প্রাথমিক শিক্ষাকে অনেকটা দুধভাত ধরে নেওয়া হয়েছে। এই সরকারের আমলে কিছু উন্নতি হয়েছে মনে হয়। কোনো কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। কিছু প্রয়োগিক শিক্ষার কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এসব এগিয়ে নেবেন, সেই শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা রাখা হয়েছে? আমরা বরাবর বলে আসছি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য। সে কারণে বেতনকাঠামো সংস্কার করে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। উন্নত দেশের কথা বাদ দিলাম, পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা একটি মেধাবী শিক্ষার্থী একই সঙ্গে কলেজ এবং প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে অনেক সময় নানা সুবিধা বিবেচনায় প্রাইমারি স্কুলেই নির্দ্বিধায় যোগদান করেন। আমাদের এখানে কয়েক বছর আগে দ্বিতীয় গ্রেডে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে না পেরে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বানিয়ে দেওয়া হলো। সবার যে শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ থাকবে তেমন নয়। আমি আমার এক স্বজনকে জানি, শিক্ষকতার প্রতি কোনো আকর্ষণ না থাকায় এখন চরম হতাশা নিয়ে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। ফলে তাঁরা শিক্ষক হিসেবে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন? আমরা যদি গ্রামগঞ্জ ও নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দিকে তাকাই ও তাঁদের শিক্ষাদান, শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ এবং স্কুলগুলোর অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ততার কথা বিবেচনা করি, তাহলে হতাশই হতে হবে। এসব দেখলে প্রশ্ন জাগে, এ দেশে শিক্ষা বাজেটের দর্শন কী! বেশির ভাগ বেসরকারি স্কুল-কলেজের অবস্থা তো আরো করুণ।
এমন বাস্তবতায় একজন মেধাবী গ্র্যাজুয়েট কেন প্রাইমারি বা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন! এই ধারার একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে বিসিএস দিয়ে সরকারি আমলা হবে। পুলিশে চাকরি করবে। অথবা কেউ কেউ সুযোগ পেলে আগেই ঢুকে যাবে সামরিক বাহিনীতে। কারণ এসব জায়গায় সম্মান ও জীবন নির্বাহে নানা স্বাচ্ছন্দ্যের হাতছানি আছে। পৈতৃক বাড়ি ছাড়া কয়জন শিক্ষক বাড়ি করা বা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের জন্য সহজ শর্তে প্লট বা ফ্ল্যাট পাওয়ার সুবিধা রাখেনি বাজেট।
করোনাকালে সংসদ টিভিতে স্কুল শিক্ষকদের ক্লাসগুলো সুযোগ পেলেই আমি দেখতাম। কী চমৎকার পড়াতেন তাঁরা। তাঁদের বেশির ভাগই ঢাকার নামি স্কুলের শিক্ষক। তাঁদের কেউ কেউ আমার ছাত্র-ছাত্রীও। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উজ্জ্বল ফল করে বেরিয়েছেন। পিএইচডিও করেছেন কেউ কেউ। তখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবি—আহা, এই মানের শিক্ষক যদি আমাদের প্রাইমারি আর মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে নিয়োগ দেওয়া যেত! ভালো শিক্ষক যে এখনো স্কুলগুলোতে নেই তা নয়, কিন্তু জ্ঞানচর্চা ও বিতরণে যে মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি ও প্রণোদনা থাকা দরকার, আমরা শিক্ষা বাজেট তৈরির সময় তা বিবেচনা করি না।
সরকারি বাজেট থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট বরাদ্দ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সাধারণ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা থাকতেই পারে। বিশেষ করে যখন সংবাদমাধ্যমে জানতে পারে এশিয়ার বা বিশ্বের হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কোনো স্থান নেই। কখনো কোথাও কায়ক্লেশে তালিকার তলানিতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাওয়া যায়। অনেকেই হয়তো জানে না এই তালিকায় নাম থাকার সঙ্গে শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠদানের পয়েন্ট খুবই অল্প। প্রধান ভূমিকা পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান সৃষ্টি কতটা করল এর ওপর। অর্থাৎ গবেষণা ও গবেষণালব্ধ ফলাফল। বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ের গবেষণার জন্য ল্যাব বা গবেষণাগার প্রয়োজন। প্রত্নতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের গবেষণার জন্য গবেষণাগার ও ফিল্ড ওয়ার্কের প্রয়োজন পড়ে। এসব গবেষণায় প্রচুর অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন আছে। বাজেট প্রণয়নকারী মহাজনদের সামনে কি এ হিসাব থাকে? অল্প তেলে মচমচে ভাজা কতটা সম্ভব? আমাদের শিক্ষকরা তো অযোগ্য নন। গবেষণার প্রয়োজনে যাঁরা বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পান, সেখানে অনেকেই মেধাবী ফল অর্জন করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। কিন্তু দেশে ফিরে তাঁরা এই জ্ঞানকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। সুযোগ পেয়েও অনেক শিক্ষক অর্থাভাবে গবেষণার জন্য বিদেশে যেতে পারেন না। অথচ সরকারি অর্থ ব্যয় করে সরকারি চাকুরে, যাঁরা পরবর্তী সময় গবেষণায় যুক্ত থাকবেন না, সেসব ক্ষমতাবান হরদম বিদেশে পড়াশোনা করে আসছেন।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি অনুষদে একটি গবেষণা ফান্ড থাকে। সেখানে প্রতিবছর শিক্ষকরা গবেষণা প্রকল্প জমা দেন। এতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পান, তা দিয়ে গভীর গবেষণা সম্ভব নয়। দায়সারা গোছের গবেষণাই করতে হয়। আমার একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে। বছর বিশেক আগের কথা। শরীয়তপুরের একটি প্রত্নগুরুত্বপূর্ণ বাড়ির ইতিহাস নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছিলাম। শরীয়তপুরে বারবার মাঠ পর্যায়ে কাজ করা, বিভিন্ন লাইব্রেরিতে যাওয়া, তথ্যানুসন্ধানে কলকাতার লাইব্রেরিতে যাওয়া—এসব করে আমার লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি বরাদ্দ পেয়েছিলাম ১২ হাজার টাকা। আবার এই টাকার নানা রকম হিসাব-নিকাশ তৈরি করে জমা দিতে হয়েছিল। বুঝলাম এসব গবেষকের কর্ম নয়। অভিজ্ঞতার কারণে এটিই আমার প্রথম ও শেষ গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেওয়া ছিল। এরপর যা করেছি, তা ব্যক্তিগত অর্থে নিজের দায়বোধ থেকে।
প্রতিবছর ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট বরাদ্দ করে। ঘোষিত বাজেটের অঙ্ক দেখে স্বস্তি প্রকাশের কোনো কারণ নেই। বরাবরের মতোই এই বাজেটের বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা প্রদান ও শিক্ষার্থীপ্রতি সাবসিডি প্রদানে ব্যয় হয়ে যাবে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে অবকাঠামো উন্নয়নে বাড়তি খরচ হবে। বাড়তি ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ব্যয় বরাদ্দ বাড়বে। যেটুকু বাড়তি বরাদ্দের কথা শোনা যাচ্ছে, তা দিয়ে এসব দৃশ্যমান খরচ মেটানো কঠিন হবে। আবার অনেকেই হয়তো জানি না, বছরের মাঝামাঝি সরকার নানা সংকটের কথা বলে ঘোষিত বাজেটের একটি অংশ কেটে নেয়। সুতরাং শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত পরিবর্তনের জন্য দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বাজেট থেকে তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না। এখানে একটি শুভংকরের ফাঁকি থাকে।
ফলে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে শিক্ষা বাজেট গতানুগতিক ধারায়ই চলে। এই বাজেটের ওপর ভর করে শিক্ষা গবেষণায় বড় রকমের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। এভাবে প্রতিবছর বাজেটের আগে আশায় বুক বাঁধি বটে, তবে চলমান শঙ্কা দেহ-মনজুড়ে প্রবলভাবে অবস্থান করে।
লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়