ক্যাথেড্রাল আর ক্যাসেলের শহর এডিনবার্গ

নাইমুল আজম খান |

ব্রিটিশদের বরাবরই একটা বদনাম আছে। সেটা হলো, ওরা ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। অনেকে তাই তাদের বেনিয়া বলে গালি দেয়। ওই বাণিজ্যসূত্রেই ওরা দখল করেছে একের পর এক দেশ। সেগুলোর একত্রিত বনেদি নাম এখন কমনওয়েলথ। বাংলাদেশ কমনওয়েলথভুক্ত একটি দেশ। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে ভিসা ফি মেয়াদ অনুযায়ী হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে ব্রিটেনে ১৫দিন, ৩ মাস বা ৬ মাস মেয়াদভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভিসা ফি দিতে হয়।

জাতিসংঘ আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের নিয়মানুযায়ী এবার বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের ভিসা ফি মওকুফের ব্যবস্থা থাকলেও নানা বাহানায় টাকা আদায়ে বদ্ধপরিকর ছিল ওরা। ভিসা প্রসেসিংয়ের নামে পোহাতে হলো বাণিজ্যের প্রথম ধাক্কা। প্রসেসিংয়ে কোনও সহায়তা না পেয়েও দিতে হলো হাজার দুয়েক টাকা। আর চা-বিস্কুট খেয়ে আরাম সোফায় বসে জমা দিতে হলে লাগত সাড়ে সাত হাজার টাকা। অর্থাৎ বিলেত যাবে টাকা দেবে না, এটা তো হতে পারে না।

ভেবেছিলাম, স্কটল্যান্ড গিয়ে এ থেকে নিস্তার পাব। কিন্তু হলো না। সম্মেলন উপলক্ষে হোটেলভাড়া বেড়েছে ৫ গুণ। এয়ারপোর্ট নেমে গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার জানাল, বাজেটের মধ্যে থাকতে হলে আমাদের ৬৮ কিলোমিটার দূরে এডিনবার্গের এক বনে থাকতে হবে। দূরত্বের কথা ভেবে মন সায় দিচ্ছিল না তাই বেশি দামে কাছাকাছি হোটেলে উঠলাম। মাঝারি মানের হোটেল, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তা ওখানে আস্তানা গাড়ায় সেখানেই উঠে পড়লাম। তবে ফিরে আসার আগে আফসোসের সীমানা ছিল না, যখন জানলাম আমরা ফিরে আসার পর হোটেলের  ভাড়া হবে ৪৮ পাউন্ড। বুঝলাম বাটপারির কোনো এলাকা নেই।

স্কটল্যান্ডের নাম Land of Cathedral বা Land of Fort রাখলে বোধহয় ভাল হতো। কারণ এখানে দুর্গ  আর ক্যাথেড্রালের অভাব নেই। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে  তাই এডিনবার্গের নতুন পুরোনো মিলিয়ে প্রায় দু’হাজার স্থাপনা স্থান পেয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায়। ওদের বিখ্যাত  ক্যাসেলগুলোর তালিকায় আছে উক হার্ট এবং গথিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি সেন্ট গেইস ক্যাথেড্রাল। এগুলো এখনও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রোমানদের পুনঃ পুনঃ আক্রমণের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা অনেক দূর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এডিনবরারা ক্যাসেল দুর্গ, যা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে জাদুঘর হিসেবে। রত্ন, মণিমুক্তা, পোশাক, সামরিক যন্ত্রপাতি প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। ১৫ থেকে ১৯ শতাব্দী সময়কালে হাজার তিনেক রাজপ্রাসাদ যুক্ত হয়েছে এখানকার স্থাপত্য তালিকায়।

এডিনবার্গের ঐতিহাসিক ক্যাসেল দুর্গ এখনো সংরক্ষণ কুশলতার জন্য প্রায় অবিকৃত রয়েছে। ইট ও পাথরে তৈরি দুর্গটিতে কামান ও অন্যান্য সামরিক সজ্জা দেখে মনে হয়, দুর্গটি যেন এখনো বহিঃশক্তির হামলা ঠেকাতে প্রস্তুত। আমরা ঐতিহাসিক সূত্রে লালবাগ কেল্লা বলে একটি দুর্গ পেয়েছিলাম। কিন্তু এর বহির্কাঠামো দর্শনীয় হলেও প্রেক্ষাপট বর্ণনার বিষয়টি উপেক্ষিত। অথচ এডিনবার্গ দুর্গে জাদুঘরের অভ্যন্তরে অডিও ভিডিও-এর মাধ্যমে ইতিহাস এবং উপস্থাপিত বিষয়ের ব্যাখাদানের ব্যবস্থা আছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস জানে না বলেই হয়তো ইতিহাসবিমুখ হয়ে পড়েছে। ওদের জাদুঘরে আরেকটা বিষয় আমার খুব ভালো লেগেছে। সেটা হলো সত্যকথন। বৃটিশরা যে বাণিজ্যসূত্রে উপনিবেশিক দেশগুলোতে লুটপাট করেছে, তার সরল স্বীকারোক্তিও আছে ওদের জাদুঘরের একটা উপস্থাপনায়। Loot and Prize শিরোনামে একটা কর্নারে উল্লেখ আছে, ‘British military history features widely known & documented instances of looting by British forces, conducted according to military custom and regulation. The British government and it's military assumed that property taken in war belonged to the British Crown by rights.’ 

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে আমি লন্ডনে বৃটিশ মিউজিয়ামে গেছিলাম। কিন্তু সেখানে এ জাতীয় সত্যকথনের লেশমাত্র ছিল না। হয়তো স্কটিশরা ইংরেজদের চেয়ে আলাদা বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। মারণাস্ত্রকে যে দৃষ্টিনন্দন করে উপস্থাপন করে দর্শকপ্রিয়তা লাভ করা যায়, তাও টের পেলাম ওখানে গিয়ে। স্বর্ণখচিত পিস্তল, তীরধনুক, রাইফেলের নানা প্রকরণ ও নান্দনিকতা যে কারো দৃষ্টি কাড়তে বাধ্য। হাসপাতাল, জাহাজশিল্প  এমনকী ব্যাগপাইপারের কিছু নিদর্শনও আছে ওখানে। বলে রাখা ভাল ব্যাগপাইপ, টাইটানিক জাহাজ নির্মাণের আঁতুড়ঘরও এই স্কটল্যান্ড।                                                                                                                                                      
আমরা যখন এডিনবার্গের দুর্গ পরিদর্শনে গেলাম, তখন বাইরের তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র বাতাস। গরমের মত শীতও যে জীবন ওষ্ঠাগত করতে পারে, ওখানে গিয়ে টের পেলাম। তীব্র শীত আমার কাপড়ের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে হাড়ে গিয়ে এমনভাবে কামড় বসাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। তারপরও এত কষ্ট করে যাবার কারণে পালানো হলো না। সে সঙ্গে ওদের ইতিহাস জানবার ইচ্ছেটা তো আছেই। এডিনবার্গ দুর্গকে কেন্দ্র করে ওখানে সংস্কৃতির একটা আবহ তৈরি হয়েছে। সারাবছরই ওই দুর্গকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতেই থাকে।

এডিনবার্গ স্কটল্যান্ডের রাজধানী হওয়ায় এর আলাদা একটি গুরুত্ব তো আছেই তারপরও পর্যটকদের আনাগোনা থাকায় বোধ করি বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই চলে এই দুর্গ এলাকা ঘিরে। দুর্গের ওপর থেকে নিচের ঢালু পথে জায়গায় জায়গায় চলে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। বছর জুড়ে চলে এসব আয়োজন। এর নমুনা পেলাম দুর্গ থেকে নামার পথে এক জায়গায়। পাশাপাশি তিনটি আয়না এমনভাবে সেট করা আছে যে, সামনে দাঁড়ালে কোনওটায় আপনাকে মোটা, কোনটায় পাতলা, আবার কোনটায় লম্বা দেখা যাবে। আরও নিচে এসে দেখলাম পেঁচার প্রদর্শনী, উপজাতীয় দুই নারী হাতে পেঁচা রেখে দেখাচ্ছিলেন নানা কসরত। বিখ্যাত ব্যাগপাইপারদের সুরমূর্ছনা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মোহিত করেছিল। বিখ্যাত পরিচালক আর, জে, কাউলিং যে এলিফ্যান্ট ক্লাবে বসে তার শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ চলচ্চিত্র হ্যারি পটারেরর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, সে ক্লাব দেখার ইচ্ছে  ছিল। কিন্তু বন্ধ থাকায় তা দেখা হলো না। ফলে একটা অতৃপ্তি যেন রয়ে গেল।         

শেষ করছি  ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে। এবার স্কটল্যান্ড আসার আগে প্রয়োজনীয় লোক জন ছাড়া কাউকে জানাতে চাইনি বিদেশ যাচ্ছি। কারণ সর্বত্র অনিশ্চয়তা। সরকারি আদেশ বা জিও কিংবা ভিসার পরও টেনশন ৪৮ ঘণ্টা আগে কোভিড টেস্টের রেজাল্ট কী হয়? কিন্তু আশ্চর্য হলাম জনৈক খবর বিক্রেতার একটা পোস্ট দেখে। ভদ্রলোক পরিচিত মহলে খুব এলেমদার লোক বলে পরিচিত। খবরের ব্যবসা করে উনি বিন্দু থেকে বৃত্ত হয়েছেন। উনি সম্মেলনের পুরোটা লাইভ প্রচার করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ৯০-এর দশকে। আমি তখন একটি দৈনিকের বিভাগীয় সম্পাদক। পত্রিকায় আমার বিভাগে একজন প্রতিবেদক দরকার। বেতন হবে ২ হাজার টাকা। এত অল্প বেতনে কেউ রাজি হবেন বলে আমার মনে হলো না। আমাদের সম্পাদক ঝানু লোক। বললেন, ‘অমুককে বলেন। উনি রাজি হবেন। আমি ভাবলাম কী করে সম্ভব? উনাকে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বাসা ভাড়া করে থাকতে হবে, খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ। সম্পাদক মুচকি হেসে বললেন, ‘বলেই দেখুন একবার।’ 

আমাকে যারপর নাই বিস্মিত করে তিনি রাজি হলেন। এরপর তার সঙ্গে আমার বেশিদিন কাজ করার সুযোগ হয়নি। অন্য দশজন মধ্যবিত্তের মত সরকারি চাকরির নিশ্চিত জীবনের প্রত্যাশায় আর এই ‘সাংঘাতিক’ পরিচয়ে ভাগ্য পরিবর্তন আমার কর্ম নয়’ ভেবে পালালাম। এরপর দীর্ঘসময় ওই অঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কর্মসূত্রে কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়। তাদের কাছে শুনেছিলাম ওই দুহাজা র টাকা বেতনের খবর বিক্রেতার ভাগ্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, ফ্ল্যাট, কথায় কথায় হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়ানো--এখন নাকি তার নিত্যকার ঘটনা। এবার সম্মেলনে এসে তার প্রমাণ পেলাম। মনে মনে ভাবছি, রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ বা অন্য কোনো পেশার মানুষের রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তন হলে পত্রিকায় খবর হয়। কিন্তু এসব খবর ব্যবসায়ীর খবর করবে কে? বিষয়টা অনেকটা ‘বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে’ এর মত ব্যাপার হয়ে গেল না?

লেখক: নাইমুল আজম খান, উপসচিব, জাতীয় সংসদে কর্মরত। সাংবাদিক থাকাকালে তিনি সোহেল আজম নামে লিখতেন।   


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034539699554443