ক্রান্তিকালের সীমারেখায় শিক্ষক ও শিক্ষকতা পেশা

অলোক আচার্য, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

শিক্ষা ও শিক্ষক একটি দেশের মেরুদণ্ড। শিক্ষকতাকে কেউ বলেন পেশা, কেউ নেশা আবার কেউ বলেন সেবা। সে যাই বলেন বর্তমানে শিক্ষকতা পেশা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শিক্ষকতা পেশা এখন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে ফাঁটল ধরেছে। একটি কাঠামো অনেকটা ভেঙে পরেছে। শিক্ষকরা এখন চাকরি ক্ষেত্রে দুটি সমস্যার মুখোমুখি। প্রথমত- নিজেদের বেতন যা শিক্ষককে সামাজিক সম্মানের একটি রেখায় পৌঁছে দিতে পারে এবং দ্বিতীয়ত- প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক। সমাজে অহরহ ঘটছে শিক্ষক পেটানোর ঘটনা। শিক্ষকদের আজকাল অভিভাবকরাও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করছে আবার শিক্ষার্থীরাও করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে শিক্ষকদের টেনে পদচ্যুত করেছে তা এক কথায় ঘৃণিত কাজ। এই অপমান কোনো রাষ্ট্রে শিক্ষকদের প্রাপ্য হতেই পারে না। সে শিক্ষক যতই অপরাধী হোক না কেনো। শিক্ষকদের পেশাকে রাজনীতিকরণে দোষ শিক্ষকের নয় বরং স্থানীয় রাজনীতিবিদদের। আর এরপর রইলো শিক্ষকদের বেতন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিচের দিকে।

অথচ দেশ হিসেবে আমরা কিন্তু অতোটা পেছনে নেই। বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন এতোটাই কম যে তাদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা চালানোর জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। এই দুই সমস্যার বাইরেও রয়েছে আরো সমস্যা।

শিক্ষকদের নিজেদের দোষও রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার ঘটনাও শিক্ষকরা ঘটিয়েছেন। এই দায়ও তারা এড়াতে পারেন না। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সেই দেশের মেধাবী সন্তান। এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই মেধাবীদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। তার ওপর নির্ভর করে সেই দেশ কত দ্রুত এগিয়ে যাবে বা উন্নত হবে। যদি মেধাবীরা অবহেলিত থাকে তবে তা দেশের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। সেই মেধাবী সন্তানরা প্রথম পছন্দ হিসেবে কোন পেশা বেছে নেবে তা নির্ভর করে সেই দেশের সেই পেশার আর্থিক সুবিধা, সামাজিক স্বীকৃতি, পদমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর। আমাদের দেশে যেমন মেধাবীরা প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেয় বিসিএস দিয়ে কোনো সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করার। যাদের সামর্থ্য আছে তারা চলে যায় বিদেশে এবং একসময় সেখানেই স্থায়ী হয়। কিন্তু যদি কোনো দেশের চিত্র এমন হয় যে, সেইসব দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা চাকরি করছেন শিক্ষকতায়। ছোটবেলা থেকেই একটি শিশু স্বপ্ন দেখছে তার শিক্ষকের মতো বড় কেউ হওয়ার। 

 দৈনিক শিক্ষাডটকম থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে বর্তমান শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত সরকারি কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারি কলেজসহ শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার। দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৩১২। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত নরওয়েতে যথাক্রমে ১:১১ এবং ১:১০, স্পেনে যথাক্রমে ১:১৩ এবং ১:১০, জাপানে যথাক্রমে ১:১৬ এবং ১ :১২, ফ্রান্সে যথাক্রমে ১:১৮ এবং ১:১৩, যুক্তরাষ্ট্রে ১:১৬, যুক্তরাজ্যে যথাক্রমে ১:২১ এবং ১:১৬। বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে ১:৩৮, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ১:৪, স্কুল ও কলেজগুলোতে গড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০, মাদরাসা শিক্ষা পর্যায়ে ১:২৪, টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল শিক্ষায় ১:২১, প্রফেশনাল শিক্ষায় ১:১১, টিচার এডুকেশন প্রোগ্রামে ১:১২, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় ১:৪০। সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে ১:৩২। বিশেষ করে প্রাইভেট কলেজ পর্যায়ে ১:৩৭, পাবলিক কলেজ পর্যায়ে ১:৫৩। একইভাবে স্কুল ও কলেজকে একসঙ্গে ধরা হলে প্রাইভেট পর্যায়ে ১:২৯, পাবলিক পর্যায়ে ১:৪১। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১:২২, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১:৫৮ রয়েছে। এই চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এদেশের শিক্ষকরা কতটা মানসিক চাপ সহ্য করে চাকরি করেন। অনেকেই এই মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেন না। তবুও করতে হয় জীবিকার তাগিদে। তারপরও একটি স্ট্যান্ডার্ড বেতন তারা পান না। 

পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। আমি আমাদের দেশেও এরকম একটি চিত্র আশা করি। এদেশে শিক্ষকের মর্যাদা অধিকাংশক্ষেত্রেই মুখে, বাস্তবতা ভিন্ন। আজও শিক্ষকরা কষ্টেই দিনযাপন করছেন। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে বহু অপ্রাপ্তি আর এসব অপ্রাপ্তি নিয়েই তারা শেখানোর কাজটি করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। একেকজন শিক্ষক হলো একেকজন সুপার হিউম্যান। অথচ তাদের বেতন কিন্তু সুপার হিউম্যানের মতো না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা আজও তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, নন-এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, সরকারি কলেজ। এসব শিক্ষকের বেতনেও রয়েছে পার্থক্য। ফলে সামাজিক পার্থক্য বিদ্যমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বারবার বলা হলেও এই শ্রেণির শিক্ষকদের দিকে সুদৃষ্টি আজও পরেনি কতৃপক্ষের। যে স্তরটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে সেই সস্তরের শিক্ষকরা কিভাবে তৃতীয় শ্রেণির চাকরি করেন তা আমার বোধগম্য নয়।  

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও বহু লেখালেখি হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং অধিকাংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রভাব খাটিয়ে তাদের পছন্দসই প্রার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই কোনো মেধাবী চাইলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পায়নি। কারণ চাকরি পেতে টাকা বা সেরকম কেউ আত্মীয় হয়তো তার ছিলো না। কিভাবে এটা হয়েছে আজ তা সবার জানা। সেসব মেধাবীদের চোখের জল ঝরানো ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। আজ যে পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এটি আরো অনেক আগেই প্রয়োগ করা উচিত ছিলো বলে আমার মনে হয়। তাহলে আমরা আমাদের পুরো শিক্ষায় মেধাবীদের দেখতে পেতাম। একজন মেধাবী শিক্ষক একজন মেধাবী ছাত্র তৈরি করতে বেশি পারদর্শী। আজ যেমন একজনের স্বপ্ন থাকে বিসিএস, ব্যাংক বা এরকম বড় কোনো পদে চাকরি করার, তেমনি এই স্বপ্ন যদি শিক্ষক হওয়ার হতো তাহলে বেশ ভালো হতো। বলা যায়, এদেশে শিক্ষক হয় ভাগ্যচক্রের শিকার হয়ে! অথবা কোনো চাকরি না পেয়ে। এ নিয়ে রঙ্গ রসিকতাও কম নেই! শিক্ষকতা পেশায় যদি প্রবেশের আগে যদি তার যাচাই পদ্ধতি ওইসব বড় বড় চাকরির মতো হতো এবং পরবর্তী সুযোগ সুবিধা সেসব চাকরির মতো হতো তাহলে আজ শিক্ষকতা হলো সবার প্রথম পছন্দের পেশা। শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি বেতন কাঠামো তৈরির কথা বলা হলেও আজ অবধি তা সম্ভব হয়নি।  

প্রথম শ্রেণির মানুষের কাছ থেকেই করা উচিত। আর এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত, সরকারি-বেসরকারি এতসব পার্থক্য না করে যোগ্যতম ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সবাইকে এক মর্যাদায় দেখতে হবে। তাহলে শিক্ষকদের ভেতর কোনো দুঃখ থাকবে না। কারণ সরকারি বলেন আর বেসরকারি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায় বলি, কাজ তো শেখানো। ক্লাসে পাঠ দেয়া। সেই একই কাজের এত পার্থক্য থাকবে কোন কারণে আমার বোধগম্য নয়। প্রতিটি স্তরেরই সমান গুরুত্ব রয়েছে এবং একটি স্তরে উত্তীর্ণ না হলে অন্য স্তরে যাওয়া সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন তারা কোনো না কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জ্ঞান অর্জন করেছে। সবস্তরেই শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষার্থী নিয়ে প্রচুর গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং সেরকম একটি সময় হয়তো একদিন আসবে যেদিন শিক্ষকরা হবেন সবচেয়ে মেধাবী আর তাদের সুযোগ সুবিধা হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। 

লেখক: শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026950836181641